সিংহ রাশির জাতকের কথা
আজকে যেই দিনটা চলে যাচ্ছে সেইটা কি আবার ফিরে আসবে? উত্তরটা আমি দিচ্ছি। হুবহু অবশ্য ফিরে আসে না। পরের বছর একই মাসের একই তারিখের দিনটা ঘুরে আসবে। কিন্তু বাকী সব সংখ্যা একই থাকলেও বছর এক ঘর এগিয়ে যাবে। বিজ্ঞানের গণনা অনুযায়ী সূর্য বড় একটা চক্কর দিয়ে বছরের একই সময়ে আগের জায়গায় ফিরে আসে। কিন্তু এর মধ্যে পার হয়ে যায় ৩৬৫ দিন। এই সময়কালে প্রতি সাড়ে বারো ঘণ্টায় একবার করে জোয়ারে পানি বাড়ে এবং ভাটায় একবার করে কমে। কত কিছুরই না রদবদল হয়ে যায়। হাজারও নতুন আগমন ঘটে। আবার একই তালে কত কিছু-ই না হারিয়ে যায় সময়ের অতল গহ্বরে। এই-ই হচ্ছে প্রকৃতির অমোঘ নিয়ম। তারপরেও মানুষ চলে যাওয়া কিছু দিন স্মরণ করে; উদযাপন করে। সামনের দিনগুলোর জন্য শুভ কামনা করে। কিন্তু কেন করে? ভালো প্রশ্ন। হয়তো আমরা সবাই আনন্দ দিতে, নিতে ও তার উপর ভর করে সুন্দর স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসি। সে রকমই একটা উদাহরণ হতে পারে জন্মদিন পালন।
এই অধমের জন্ম সেই মেলা বছর আগের এক জুলাই মাসে। সেই ছোট বেলা থেকেই মাসটা এলে কেমন যেন উদ্বেলিত হয়ে পড়ি। এইবারও ব্যতিক্রম হয় নি। বছরের পরিক্রমায় জন্মের দিনটা ফিরছে। কিন্তু জোয়ার-ভাটার সাথে আমার চিন্তা-ভাবনা ও উৎসাহ কেমন যেনো বদলেই চলেছে। কথাটা না হয় আরেকটু ব্যাখ্যা করি। ছোটবেলায় বাড়িতে বাধ্যতামূলক নিয়ম ছিল সন্ধ্যা হলে বই নিয়ে পড়তে বসা। তবে বাড়ির বড় যারা তাদের ক্ষেত্রে এই বিধি প্রযোজ্য ছিল না। তারা গল্প করে এবং টিভি দেখে সময় কাটাতে পারতেন। তখন আমার লক্ষ্য ছিল দ্রুত বয়সে বড় হয়ে সান্ধ্য-কালীন পড়ালেখার চাপ থেকে মুক্তি পাওয়া। সময়ের সাথে ঠিকই বেড়ে উঠেছি এবং পাঠ্য বই থেকে দূরে থাকার অধিকার পেয়েছি। কিন্তু এখন মনে হয় সেই ছোট বেলার অধ্যয়নের দিনগুলোই বুঝি ভালো ছিল। তখন জানা ছিল না বয়স বাড়ার সাথে হাজারও দায়িত্ব ঘাড়ে এসে বসার একটা সম্পর্ক আছে। তবে বলছি না অর্পিত দায়িত্ব পালনে আমার কখনও অনীহা হয়েছে। বরং সফল দায়িত্ব পালনে স্বর্গীয় সন্তুষ্টি পেয়েছি।
অনেক ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালনের সাথে মন-মানসিকতার পরিবর্তন চলে আসতে পারে। আমাদের আমলে ছাত্ররা ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পরীক্ষার দেয়ার সুযোগ পেতো। তাতে পাশ করলে স্কুলের বেতন ফ্রি। সাথে আবার কিছু মাসহারা। সেজন্য বৃত্তি প্রাপ্তদের অভিভাবকেরা আনন্দিত হয়ে সন্তানদের নাম, ছবি পত্রিকায় ছাপিয়ে দিতেন। এতে ছাত্র ও পরিবারের সাফল্যের কথা জেনে অন্যরা সাধুবাদ দিতেন। মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের ছবি দেখে ও বৃত্তান্ত পড়ে আমার শিশু মনেরও নিজের ছবি পত্রিকায় দেখতে ইচ্ছা হয়েছিল। কিন্তু স্কুল পরিবর্তনের কারণে ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পরীক্ষা দেয়া হয়ে উঠে নি। অবশ্য ক্লাস এইটে ঠিকই বৃত্তি পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হয়েছিলাম। কিন্তু তিন বছর পর নিজের ছবি পত্রিকায় ছাপিয়ে অন্যদের দৃষ্টি আকর্ষণের আগ্রহ আর থাকে নি।
জন্মদিনের কেকের উপরে মোমবাতির সংখ্যা থেকে উপস্থিত মানুষের থেকে কম হলে বুঝতে হবে বয়সটা বেড়ে গেছে। শুনেছি বয়স বাড়লে বুদ্ধি-শুদ্ধি কমতে থাকে। ঠিক সময়ে ঠিক জিনিসটা মনে পড়ে না। জন্মদিন নিয়ে জুতসই একটা গল্প বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এই মুহূর্তে সে রকম কিছু মনে এলো না। তারপরেও একটা গল্প বলি। জঙ্গলের দু গাধার বেশ কয়েকদিন খাওয়া দাওয়া হয় না। রোদে ঘাস পুড়ে একেবারে ছাই। তারা ঠিক করলো জনপদে এসে খাদ্য খুঁজবে। যা ভাবা সেই কাজ। তারা হাঁটতে হাঁটতে এমন জায়গায় চলে এলো যেখানে রাস্তা পার হয়ে অন্য দিকে গেলে বিশাল বড় এক পার্ক। সেখানকার দূর্বা সবুজ ঘাস দেখে দু জনের জিহ্বায় পানি চলে এলো। এক গাধা দৌড়ে রাস্তা পার হতে নিলো। তখন অন্য গাধা তাকে টেনে ধরে বলল, “খবরদার রাস্তা পার হওয়ার চেষ্টা করিস না। দেখছিস না রাস্তায় কয়েকটা জেব্রা কেমন পিষে মিশে লেগে আছে। ওরা নিশ্চয়ই ঘাস খাওয়ার জন্য দৌড় দিয়ে রাস্তা পার হতে গিয়েছিল। তার পরে গাড়ির তলায় পড়ে চ্যাপ্টা হয়ে একেবারে জেব্রা ক্রসিঙে পরিণত হয়েছে।” কেন বললাম গল্পটা বললাম সেটা এবার বলি। মাসের প্রথম দিনেই এমেরিকার নামজাদা ক্যাসিনো আমাকে শুভ জন্মদিন জানালো। তার কয়েকদিন পর ইমেল করল, আমি তাদের সাথে জন্মদিন পালন করলে আমাকে কিছু লোভনীয় ডিসকাউন্ট ও বিনা মূল্যে জন্মদিনের কেক দেয়া হবে। হুমম!! ভাবলাম ক্যাসিনোতে গ্যাম্বেল করে একগাদা টাকা জিতে আনবো না-কি। না পরে ওদের ফাঁদ থেকে নিজেকে বাঁচালাম। বরং ঠিক করে ফেললাম নিজের বাসায় নিরিবিলিতে জন্মদিন পালন করবো।
জীবনে কি আমি সবগুলো সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছি? অবশ্যই না। পিছনে ফিরে যাওয়ার সুযোগ থাকলে ভুল সিদ্ধান্তগুলো শুধরে নিতাম। কিন্তু সে উপায় যেহেতু নাই, নিজেকে এই বলে সান্ত্বনা দেই আমার সেই সময়কার বিশ্লেষণে সেগুলোই সঠিক বলে মনে হয়েছিল। আর কিছু না হোক তার থেকে শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা তো হয়েছে। “সবাই বলে বয়স বাড়ে, আমি বলি কমেরে...” হলেও আমি আমার পৃথিবীতে আমার অবস্থানকাল পরিপূর্ণভাবে উপভোগ করে যেতে চাই। জীবনের স্বাদ উপলব্ধি করে চলতে হলে পজিটিভ হতেই হয়। আমাদের ক্ষুদ্র জীবনে প্রতিটা মুহূর্ত মহামূল্যবান। সেখানে আরও একটু আনন্দের সংযোজনের সুযোগ থাকলে সেটা আমি অবশ্যই ছেড়ে দিতে চাই না। পরিবার ও বন্ধুরা এতে শামিল হলে তো একেবারে সোনায় সোহাগা। প্রকৃত জন্ম দিন ও ক্ষণ ফিরে আসুক কিংবা নাই-বা আসুক; যেহেতু জন্মদিন আমাকে নিজের জীবনকে আরেকটু রাঙিয়ে দেয়ার সুযোগ এনে দেয়: A Very Happy Birthday to me.
(বি.দ্র: জন্মদিন ২৬ শে জুলাই)
রচনাকালঃ জুলাই ২০১৯