অন্তরা

সমস্যা একটা হচ্ছে জয়নাল হোসেনের।

শুক্রবার সকাল। ইচ্ছা ছিল মিলি উঠার আগেই পত্রিকার প্রথম পাতা থেকে শেষ পাতা পর্যন্ত সব পড়ে ফেলবে। সারা সপ্তাহের না জানা ঘটনাগুলো জানা হয়ে যাবে। ইদানীং অফিসে কাজের খুব চাপ। পত্রিকা খোলার সময় হয় না। তাই সেই ছোট বেলার অভ্যাসটা শুক্রবারে পুষিয়ে নেয়া আর কি!

মিলি উঠে গেলেই আরেক সমস্যা। পত্রিকা নিয়ে সময় কাঁটানো তার একেবারেই পছন্দ না। সে সোজা কথার মানুষ। যা হয়ে গেছে, তা নিয়ে মাথা ঘামানোর কি আছে? যা হওয়ার তাই হয়েছে। কি হয়ে গেছে তা নিয়ে মাথা গরম না করে, যা হতে যাচ্ছে সেটা নিয়ে কাজ করাটাই ভালো। জয়নালের পত্রিকা পড়া দেখলে, মহা বিরক্ত হয়ে বলবে; যাও এখুনি বাজারে যাও। সকাল সকাল গেলে ফ্রেস মাছ পাবে।

জয়নালের এই জন্যে সপ্তাহের অন্যান্য দিনের মতো শুক্রবারেও সকাল সকাল উঠা। মিলি উঠার আগেই পত্রিকা পড়ে শেষ করতে হবে। তার পরে, দিনের বাকীটুকু সময় প্রিয়তমা স্ত্রী মিলি হোসেনের কথ অনুযায়ী চলতে হবে। মনে যত ধরণের যত ইচ্ছা আসুক না কেন, তা মনের মধ্যেই রাখতে হবে। প্রকাশ পেলে কঠিন কোনো কথা শুনতে হতে পারে। ইদানীং মিলির মেজাজ মনে হয় সব সময় তাতিয়ে থাকে। জয়নাল কোন কথা বললেই তেড়ে আসে। জয়নালের যেন কোনো ইচ্ছা আর মতামত থাকতে নেই। মিলির কথা মতোই সব হতে হবে। কিছু বলতে গেলে বিরাট ঝামেলা। এর থেকে মনের ইচ্ছা মনের মধ্যে অভুক্ত রেখে মেরে ফেলাটাই ভাল।

কিন্তু পত্রিকাটা গেল কোথায়? শুক্রবারে এই সময়ের মধ্যে পত্রিকা চলে আসে। টেবিলে এক কাপ চা, চোখে চশমা ও অন্যান্য সবকিছু জায়গা মতোই আছে। ঠিক এখানে মানে এও চেয়ারে বসেই তো সে পত্রিকা পড়ে। কিন্তু পত্রিকাটা জয়নাল কোথাও দেখছে না। এইদিক ওইদিক তাকাল, না পত্রিকাটা কোথাও দেখা যাচ্ছে না। জয়নাল একেবারেই নিশ্চিত, সে প্রতি শুক্রবারে পত্রিকা পড়ে। এর কোনো ব্যতিক্রম হয় না। কিন্তু আজকে পত্রিকা গেল কই? বেচারা অসহায় হয়ে করুণ চোখে চারিদিকে তাকিয়ে খুঁজতে লাগল।

সাথে সাথে মাথাটা কেমন যেনো ঝিম ঝিম করে উঠলো।

বিলাত থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে ফিরে আসার তিন দিন পরেই মিলির সাথে বিয়ে হলো। বিয়ে ঠিক করাই ছিল। মা ছবি পাঠিয়ে বলেছিলেন, সারা বাংলাদেশে এর থেকে সুন্দরী মেয়ে নাই। তার উপর আবার কয়েক দিন পরে ডাক্তার হয়ে যাবে। পড়ালেখায় তোর মতোই ভাল। ম্যাট্রিকে মেয়েদের মধ্যে প্রথম হয়েছিল। তোরা দুই জনে মিলে আয় করবি। তার পরে দেখবি, তোদের জীবন কি সুন্দর কেটে যায়।

জয়নালের ছোট বোন দিলরুবা তখন মাত্র মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েছে। মায়ের থেকে শুনে, লুকিয়ে লুকিয়ে যেয়ে মিলিকে দেখে আসলো। খুবই অবাক হলো, এতো সুন্দরী মেয়ে কোনো ছেলের চোখে এখনও পড়ে নি, তাই বা কি করে সম্ভব? কারোর সাথে নিশ্চয়ই প্রেম আছে। সেটা যাই হোক, বিয়ে তো হচ্ছে তার নিজের বড় ভাইয়ের সাথে। বিলাত ফেরত বলে কথা। তা ছাড়া তার ভাই তো দেখতে কম হ্যান্ড-সাম না। ভাইকে দেখলে পুরনো প্রেম প্রীতির কথা এমনিতেই ভুলে যাবে। দিলরুবা ভাইকে জানাল, তোমার ভবিষ্যৎ বউ বিশ্ব সুন্দরী থেকেও সুন্দর। ভাগ্যিস সে বিশ্ব সুন্দরী কম্পিটিশনে যায়নি।

জয়নাল মা আর বোনের রেফারেন্স পেয়ে একেবারে আহ্লাদে আটকানা হয়ে গেল। সারা রাত ছবি দেখে কাঁটাল। আহা কি সুন্দর! দেখলে বুকটা একেবারে ঠাণ্ডা হয়ে যায়। গরমের মধ্যে থেকে এসে বরফ দেয়া পানি ঢক ঢক করে পান করলে যেমন হয়! শুধু ছবির দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। নিজের মনে কতো কথাই না বলে চলল। সে নিশ্চিত এই মেয়েকে পাওয়ার পর জীবনের সব কিছু-ই অর্জন হয়ে যাবে। মনে মনে পণ করে ফেলল, এই মেয়েকে মাথায় তুলে রাখতে হবে। এক ফোঁটা কষ্টও দেওয়া যাবে না। একেবারে ফুলের আচর পর্যন্ত না।

তার জন্যে শুধু ভালোবাসা আর ভালোবাসা।

মিলি হৈ চৈ করতে করতে বাথরুম থেকে বের হলো। আমার টুথ ব্রাশ ভেজা কেন? কে আমার টুথ ব্রাশ ব্যবহার করেছে। আমার বাথরুমে কে ঢুকেছিল। বাসায় চোর আসলো না কি?

মিলির চিল্লা চিল্লিতে জয়নালের পত্রিকা নিয়ে চিন্তা নিমিষেই উধাও হয়ে গেল। চোর তো বাসায় আসার কথা না। দরজা জানালা বন্ধ ছিল। চোরেরই বা কি ঠ্যাকা পড়েছে, চুরি করে এসে মিলির টুথ ব্রাশ ভিজিয়ে যাবে। আর ওই বাথরুমে তো কারো যাবার কথা না। মিলি ছাড়া সেই একমাত্র মানুষ যে ওই বাথরুম ব্যবহার করে। কিন্তু সেই বা মিলির টুথ ব্রাশ ধরবে কেন? এই সামান্য কারণে মিলি তাকে যা তা বলছে, চোর বলছে। কি সাংঘাতিক অপমানের কথা।

জয়নালের মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। আসলে এখন মনে হচ্ছে এইটা তারই দোষ। কয়েক দিন আগে মিলি নতুন দুটো টুথ ব্রাশ রেখে বলেছিল, তোমারটা নীল, আমারটা লাল। কিন্তু আজকে সকালে কিছুতেই মনে করতে পারল না, কারটা কি রঙ। শেষে, হাতে যেইটা উঠল, সেটা নিয়ে দাঁত মেজে ফেলল। ভাবল ভুল হলেও মিলি বুঝতে পারবে না।

কিন্তু অদৃষ্টের লিখন জয়নালের পক্ষে ছিল না। সামান্য এক টুথ ব্রাশ ব্যবহার করার জন্যে মিলি, মানে নিজের স্ত্রীর কাছে হেনস্থা হতে হচ্ছে। ছি ছি কি লজ্জা। মানুষে শুনলে কি বলবে?

কিন্তু এমন হলো কেন?

সে কি করে ভুলে গেল কার ব্রাশের কি রঙ। আবার পত্রিকাই খুঁজে পেলো না কেনো?

বিয়ের রাত কেমন একটা ঘোরের মধ্যে কাটল। জয়নাল বিয়ের ষ্টেজে রুমাল দিয়ে মুখ ঢেকে বসে থাকল। বউ দেখতে খুব ইচ্ছা করছিল। মেয়েটা তো আশে পাশেই কোথাও আছে। এত লোকজন না থাকলে কিছু হাসি ঠাট্টা করে আসা যেতো। যেয়ে জানতে চাইতো, খুব তো সাহস। না দেখেই একজনকে জীবন সঙ্গী বানিয়ে ফেলছো। ছেলে যদি ভয়ঙ্কর হয়, যদি দস্যু বনহুর কিংবা মাসুদ রানা হয়।

স্বপ্নের কনেকে প্রথম দেখল রুসমতের সময়। তাও আবার আয়নায়। মিলি নিচু হয়ে বিশাল ঘোমটা কিছুটা সরিয়ে আয়নার দিকে তাকিয়ে জয়নালের উদ্দেশ্যে বড় ধরণের একটা ভেঙচি কাটলো। আর কেও না দেখলেও, জয়নাল ঠিকই দেখল। বুঝতে পারল না, এর উত্তরে কি করা উচিৎ। বোকার মত একটা ঢোক গিলল। সাথে আল্লাহকে বলল, ইয়া আল্লাহ নতুন বউ যাতে বুঝতে না পারে, তার মাথায় কোন বুদ্ধি কাজ করছে না। যেই মেয়ে, রুসমতের সময় একেবারে কড়কড়ে নতুন স্বামীর সাথে রসিকতা করে ভেঙচি কাটতে পারে, সে পৃথিবীর এক এবং একমাত্র। তার কোনো তুলনা নাই।

জয়নালের বাসর ঘরে যাওয়ার আগে পর্যন্ত; সারাক্ষণ চোখের সামনে নতুন বউয়ের ভেংচি কাঁটা মুখ ভাসতে লাগল। আর অপেক্ষা সহ্য হচ্ছিল না। কখন যে সে বউকে একা পাবে, ওই ভেংচি কাঁটা মুখের লাল টকটকে ঠোটে তার নিজের ঠোট চেপে ধরতে পারবে। পুলকে শরীরে আন্দোলন চলে এলো।

প্রথমেই চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিবে ওই ভেংচি কাটা রঙ্গিন মুখ। আহা! আহা!!

মিলি ছোট বেলা থেকেই সোজা কথার মানুষ। কাওকে কিছু বলতে কখনো দুই বার চিন্তা করে না। আবার যা বলে সেই কাজ করেই ছাড়ে। সেটা মুরুব্বী কিংবা পাড়ার মাস্তান--সবার বেলাই সমানভাবে প্রযোজ্য। তাকে নিয়ে অনেক ধরণের গল্প প্রচলিত আছে। মিলিকে ঘাঁটানোর সাহস কারোর ছিল না বললেই চলে।

মায়ের ইচ্ছা ছিল ম্যাট্রিকের পর পরই বিয়ের দেবার। কিন্তু কারোর সাহস হয় নি ব্যাপারটা নিয়ে মিলির সাথে কথা বলার। অবশ্য মায়ের হাবে ভাবে বিষয়টা বুঝতে মিলির সময় লাগেনি। মিলি বাবার মায়ের উপস্থিতিতে ঘোষণা দিলো, সে ডাক্তারি পড়বে। বিয়ের কথা বলে কেও যাতে তাকে বিরক্ত না করে। সময় হলে সেই জানাবে।

এক দিন কলেজ থেকে ফিরতে বেশ দেরি হয়ে গেল। সন্ধ্যা পার হয়ে অন্ধকার। রিকশা করে বাড়ি ফিরছিল। পাড়ার বখাটে ছেলেরা মুদির দোকানের সামনে সিগারেট আর চা হাতে নিয়ে গল্প গুজব করছিল। রিকশায় মিলিকে দেখে পাড়ার নতুন মাস্তান রুক্কু বেশ জোরেই বলল, কি ব্যবসা করে বাড়ি ফেরা হচ্ছে না কি?

মিলি সাথে সাথে রিকশা থামাল। ডাকল রুক্কুকে, এই, এই দিকে আস। রুক্কু বেশ আগ্রহ নিয়েই এগিয়ে গেল। কাছে আসা মাত্রই পায়ের স্যান্ডেল খুলে রুক্কুর মুখে ছুড়ে মারল। তার পরে রিকশা থেকে নেমে ধীরে সুস্থে স্যান্ডেলটা কুড়িয়ে পায়ে দিলো। শান্ত গলায় বলল, আমার সাথে মাস্তানির চেষ্টা না করাই ভাল। এর পরে বেয়াদপি করলে আরও কঠিন শাস্তি হবে। ঘটনার আকস্মিকতায় বখাটে ছেলেগুলো কি করবে বুঝে পেলো না। রুক্কু চোখ তুলে পর্যন্ত তাকাতেই পারল না।

মিলি পায়ে হেঁটে বাসার দিকে রওয়ানা দিলো।

মিলি বিয়েতে সম্মতি দেওয়াতে চেনা জানা মানুষরা খুব অবাক হলো। বিয়ের প্রস্তাবটা বড় খালাই নিয়ে এনেছিলেন। মিলিকে বিষয়টা বলতে মায়ের সাহস হলো না। ভয় ছিল আবার না মুখ ঝামটা দিয়ে বলে, কত বার না বলেছি পড়া লেখা শেষ না করে আমি বিয়ে করবো না। কথাটা কি তোমার কান দিয়ে মাথা পর্যন্ত যাচ্ছে না। বল কি করলে কাজটা সম্ভব হবে।

কিন্তু বড় খালা ছেড়ে দেবার মানুষ না। তিনি মিলিকে ডেকে বললেন, এই খামের মধ্যে একটা ছেলের তিনটা ছবি আছে। দেখতে যেমন সুন্দর, ফ্যামিলি তেমন ভাল। ম্যাট্রিক, ইন্টারমিডিয়েট দুই পরীক্ষায় ফাস্ট হয়েছিল। আগামী মাসে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে দেশে ফিরবে। এর মধ্যে একটা মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিতে ভাল বেতনের চাকরি হয়ে আছে। দেশে ফিরে ছেলে বিয়ে করে দেশ বিদেশে মাস খানেক হানিমুন করবে। তার পরে নতুন চাকরিতে জয়েন করবে।

বড় খালা বলে চললেন, দেরী করলে ছেলে হাত ছাড়া হয়ে যাবে। পরে হাজার কান্নাকাটি করেও এমন ছেলে পাবে না, সেটা এখনই বলে দিচ্ছি। এই ছেলেকে বিয়ে করলে, জীবনের সুখের কোন কমতি হবে না। ছেলের মা বলেছে, তোমার পড়া লেখার চালানোর ব্যাপারে ওদের কোন আপত্তি নাই। ছেলে ইঞ্জিনিয়ার, মেয়ে ডাক্তার—সংসারে সুখের কোন কমতি হবে না।

দু ঘণ্টা পরে মিলি খালাকে ফোন করলো, খালা আমি রাজী।

শুধু চুমু কেন, জয়নাল প্রথম রাতেই পুরো রাজ্যটাই জয় করলো। বাসর ঘরে ঢুকে একেবারে অবাক। মিলি এর মধ্যে শাড়ি বদলিয়ে ফেলেছে। জয়নালের ধারণা ছিল খাটের উপরে মাথায় বিরাট একটা ঘোমটা দিয়ে বউ বসে থাকবে। সে ধীরে ধীরে ঘোমটা সরিয়ে রঙ্গিন মুখটা মন ভরে দেখবে। সারা রাত জেগে অনেক, অনেক কথা বলবে। নিজের সব কথা বলবে, ওর সব কথা শুনবে। কিন্তু মনে হলো সুমির কথা প্রথমে রাতেই বলাটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। আবার নতুন বউ কেমন রিএক্ট করে।

পাশের বাসার মেয়ে সুমি ছাদে উঠতো। প্রথমে চোখা চোখি, তার পরে কিভাবে যেন ভালোলাগা। একসাথে লুকিয়ে কয়েকটা সিনেমা পর্যন্ত দেখেছিল। একটু হাত ধরা ধরি আর অনেক স্বপ্নের কাঁথা বুনার বেশী আর এগুতে পারেনি। সুমির মামা ওদেরকে একদিন এক সাথে দেখে ফেললো। সুমির মায়ের কাছে সু-বিস্তারিত বর্ণনা গেল। জয়নালের বাসায় সুমির মামা এসে শাসিয়ে গেল। প্রচুর বকাবকি আর মার-ধর চললো। কিছু দিন পরে সুমিরা বাসা ছেড়ে অন্য শহরে চলে গেল। একটা সম্ভাবনার অকাল মৃত্যু হলো।

ঘোমটা সরানোর পর কথা আড়ষ্ট ভাবটা কমে আসলে বউকে হালকা করে জড়িয়ে ধরবে। না, একটু না হয় জোড়েই ধরলো; কি আসে যায় তাতে। প্রথমে অনেক আদর করবে। তার পরে এক এক করে খুব যত্নে ব্লাউজ, শাড়ি...। নতুন বউ যেনো নিজেকে একেবারে রাজরানী ভাবতে পারে।

না সে রকম কিছু হলো না। কিন্তু যা হলো সেটা জয়নালের কল্পনার বাইরে। মিলি পোশাক দেখে জয়নালের কান লাল হয়ে গেল। একেবারে বিদেশী মডেলদের রাতের পোশাক। লম্বা, লম্বা ফর্সা পা দুটো দেখা যাচ্ছে। উপরের দিকে যা পরেছে, তা দিয়ে ভিতরের সব কিছু স্পষ্ট। যাদুকরী স্তন দুটো উপরের অর্ধেক বের হয়ে আছে। কেমন যেন একটা অস্থির করা পারফিউমের মিষ্টি গন্ধ আসছে। নাকে লাগা মাত্র নেশা নেশা লাগছে। জয়নালের একেবারে পাগল হয়ে যাবার দশা। মনে হলো কান দুটো দিয়ে গরম ধুয়া বের হচ্ছে।

বেচারা জয়নাল মাথা নিচু করে যেয়ে খাটের এক কোণায় যেয়ে বসলো। কি বলবে আর কি করবে, মাথার মধ্যে খেলল না। চোখ তুলে দেখতে খুব ইচ্ছে করছিল, কিন্তু লজ্জায় সে কাজ করতে সাহস হচ্ছিল না।

মিলি জয়নালের খুব কাছে এসে প্রথম বিয়ের পাগড়িটা মাথার থেকে তুলে নিলো। জয়নালের যেই কাজটা করতে চেয়েছিল, মিলি সেই কাজটা করলো। থুতনিতে হাত দিয়ে জয়নালের মুখ উঠালো। আলতো করে জয়নালের ঠোটে ঠোট ছোঁয়াল। তার পরে জয়নালের মুখ, তার বুকে নিয়ে একেবারে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।

প্রথম কথা মিলিই আরম্ভ করল, এইটা আমার বহু দিনের প্ল্যান। পোশাকটা এক বান্ধবীর বড় বোনকে দিয়ে আনিয়েছিলাম। তুমি বিদেশ থেকে এসেছ, ভেবেছিলাম তুমি খুব বেশী অবাক হবে না। আমি আসলে ব্যাপারটা অন্য রকমভাবে করতে চেয়েছি---just to make you happy and sexy। যদি বল বিয়ের শাড়িটা আবার পরতে পারি।

না। মিলিকে বিয়ের শাড়িটা আবার পরতে হয় নি। জয়নালের এর মধ্যে শরীরে শিহরণ, আন্দোলন ও বিপ্লব আরম্ভ হয়ে গেছে। সে এই-ই চায়, এই ভাবেই চায়। টান দিয়ে খুলে ফেলল মিলির সংক্ষিপ্ত পোশাক। মিলিও তাকে এর মধ্যে বিবস্ত্র করে ফেলেছে।

হঠাৎ মিলি জয়নাল থেকে সরে গিয়ে শান্ত হয়ে বললো, তোমাকে মনে হয় একটা কথা এখনই বলে রাখা ভাল। তোমার আগে এই শরীর একজন ধরেছে। তোমার যদি এতে কোন সমস্যা থাকে, তুমি বলতে পারো। তোমার যে কোন রায় আমি মেনে নিবো। কিন্তু এতটুকু জেনে রাখো, আজকের থেকে তুমি ছাড়া এই শরীর আর কেও ছুঁতে পর্যন্ত পারবে না।

জয়নাল তখন সুখের আরেক জগতে।

মিলিরে কানের কাছে, মুখ নিয়ে বলল, এখন থেকে তুমি আমার সেটাই বড় কথা।

তোমাকে যদি আগে কেও ছুঁয়ে থাকে, I do not care.

মিলি ফিসফিস করে বলল, আমি কিন্তু ভীষণ সাহসী!

মিলির এখন খুব ব্যস্ততা। প্রথমে ছিল চেম্বার। পরে হল ক্লিনিক। তারপরে রীতিমত হাসপাতাল। প্রায় গোটা বিশেক ডাক্তার কাজ করে। সাথে নার্স আর অন্য কর্মচারীরা তো আছেই। সারাক্ষণ রুগী আর তাদের স্বজনরা আসা যাওয়া করছে। মিলির কাজের কোন ইয়ত্তা নাই।

খুব জরুরী একটা মিটিং চলছিল। বিদেশী দুটো দূতাবাস প্রস্তাব পাঠিয়েছে তারা হাসপাতালকে তাদের নেটওয়ার্ক ভুক্ত করতে চায়। তাতে বাড়তি অনেক ব্যবসা আসবে। কিন্তু তাদেরও কিছু দাবী আছে। হাসপাতালের যন্ত্রপাতি আধুনিক করতে হবে এবং কিছু ডাক্তারদের এমেরিকা আর ইউরোপে যেয়ে ট্রেনিং নিয়ে আসতে হবে। মেলা টাকার ব্যাপার। সিনিয়র ম্যানেজমেন্টের এটা নিয়ে আলোচনা চলছিল। ঠিক এ রকম সময়ে একজন জুনিয়র ডাক্তার এসে মিলির কাছে এসে বলল, এক্সকিউজ মি। আপনার ননদ আপনাকে ফ্রান্স থেকে ফোন করেছেন। বললেন, ভীষণ জরুরী। আপনার সাথে কথা না বললেই না।

জয়নালের ছোট বোন দিলরুবা ফ্রান্সে থাকে প্রায় পনের বছর হলো। ভাইয়ের চোখের মণি। দিলরুবা যদি কোন সপ্তাহ ফোন না করেছে, জয়নাল বাংলাদেশ থেকে ফোন করে অভিমানী গলায় বলে, কিরে আপু বড় ভাইকে ভুলে গেলি না-কি। ওইদিক থেকে দিলরুবা বলে, তোমাকে এত খরচ করে ফোন করার দরকার নাই। আমি এখনই ফোন করছি।

মিলি জানতো দিলরুবা নিয়মিত বড় ভাইয়ের সাথে কথা বলে। ভাই বোনের যে কত আলাপ হতে পারে!

কিন্তু তার কাছে দিলরুবার কি প্রয়োজন হতে পারে? তাও আবার জরুরী।

মেডিকেল কলেজে এনাটমির ক্লাস। করিম শায়েখ নতুন লেকচারার হিসেবে এই বছরই জয়েন্ট করেছে। লম্বা, সুন্দর, সুঠাম শরীর। বয়সে একেবারে নবীন। বাংলা, ইংরেজি—দু ভাষায় তুখার লেকচার দিতে পারে। এনাটমির মত কঠিন বিষয় ছাত্রদের বুঝতে কোন অসুবিধা হয় না। ছাত্রীরা শায়েখ সার বলতে অস্থির। মেয়েদের কমনরুমে সারকে নিয়ে অনেক ধরণের আলাপ হয়। একবার সুরমা নামে মিলিদের ক্লাসেরই এক মেয়ে বেশ গর্ব করে ঘোষণা করল, সে স্বপ্নে দেখেছে যে তার সাথে শায়েখ সারের বিয়ে হচ্ছে। আরেক দিন এসে বাসর ঘরের রসালো বর্ণনা দিলো, সার শেরওয়ানি খুলার পর আমি আর শান্ত থাকতে পারলেম না। ঝাঁপিয়ে পড়লাম সারের বুকের মধ্যে। আহা সেখানে কি আরাম। ওই বিশাল বুকে আমার হারিয়ে যাবার দশা। তার পরে সার আমাকে বুকের মধ্যে ভীষণ জোরে চেপে ধরলেন। আমার তখন ভেঙ্গে চুড়ে গলে পড়ার দশা।

সুরমা গল্প বলতো আর অন্য মেয়েদের মাথায় নানা ধরণের প্রশ্ন আসতো। সার কি শাড়ির উপর দিয়ে হাত দিলো, না কি তোর কাপড়-চোপড় প্রথমে খুললো। সুরমা আদি-রসাত্মক ভঙ্গিতে একে একে সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে চলতো।

এই সব কথা বেশী দূর এগুতে পারতো না। মিলি অনেকটা আসর ভেঙ্গে দিতো। যা যা বানিয়ে বানিয়ে কথা বলতে হবে না। আমি এখন লাইব্রেরী যাচ্ছি। তোরা কেও কি যাবি আমার সাথে?

কিন্তু মিলি তখন জানতো না, এই শায়েখ সারের সাথে তার জীবনের একটা অধ্যায় রচিত হয়ে আছে।

১০

দিলরুবা ফোনের ওইদিক থেকে অস্থির হয়ে জানতে চাইলো, ভাবী ভাইয়ার কি হয়েছে? সে আমাকে চিনতে পারছে না। প্রথমে অফিসে ফোন করলাম—বলল অফিসে আসেনি। পরে বাসায় ফোন করলাম। ভাইয়া ধরলো। বলে কিনা বলে আপনি কে বলছেন। আমি বললাম ভাইয়া আমি দিলরুবা, তোমার ছোট বোন।

উত্তরে ভাইয়া বলে, আমার আবার বোন আসলো কোথা থেকে?

আমি এই পর্যন্ত তিন বার ফোন করেছি। প্রতিবারই বলে, আপনাকে আমি চিনতে পারছি না।

মিলি একটু অন্যমনস্ক হয়ে উত্তর দিলো, তোমার ভাই মনে হয় রসিকতা করছে।

মিলি বলেই বুঝল, জয়নাল ছোট বোনের সাথে এই ধরণের রসিকতা করার মানুষ না। ইদানীং, না বেশ অনেক দিন হলো জয়নাল হাসি, ঠাট্টা তেমন একটা করে না। শুধু ছোট বোনের সাথে বেশ সময় নিয়ে কথা বলে। মিলি অবশ্য কখনো চেষ্টা করেনি কী কথা বলে জানার। সে নিজে মহা ব্যস্ত মানুষ। মানুষের কথা শোনার অবসর নাই।

মিলি ফোন রেখে চিন্তা করতে আরম্ভ করলো। এইটা কি করে সম্ভব? জয়নাল ছোট বোনকে চিনতে পারছে না।

আসলে বিষয়টা কি?

১১

বছরের শেষে পুরো ক্লাস পিকনিকে গেল কক্সবাজার। সাথে তিন জন টিচার। এদের মধ্যে একজন শায়েখ সার। বাসে করে অনেক লম্বা রাস্তা পার হতে হলো। সেই চিটাগাং হয়ে কক্সবাজার। পাক্কা দশ ঘণ্টা। প্রথম কয়েক ঘণ্টা ছেলে মেয়েরা হৈ হুল্লোড় নাচ গান করলো। তার পরে ক্লান্ত হয়ে যে যার সিটে যেয়ে বসলো। কয়েকজন ভেজা মুরগির মত ঝিমুতে লাগল। অন্যরা রীতিমত ঘুমিয়ে পড়লো।

মিলি যে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে, তা সে নিজেও জানে না। চোখ খুলে বুঝল, এতক্ষণ শায়েখ সারের ঘাড়ে তার মাথা ছিল। কি লজ্জা ক্লাসের ছেলে মেয়েরা দেখলে কি বলবে। চারিদিকে চোখ ঘুড়িয়ে দেখলো। না কেও তার দিকে তাকিয়ে নাই। যাক বাঁচা গেল। কিন্তু সারের তো পাশের সিটে বসার কথা না। উনি তো নাজমা ম্যাডামের পাশে বসেছিলেন।

নাজমা ম্যাডাম বেশীক্ষণ পা ঝুলিয়ে বসে থাকতে পারেন না। তার পা ফুলে যাওয়ার একটা সমস্যা আছে। কথাটা শুনে শায়েখ সার উঠে বললেন, আপনি সিটে পা উঠিয়ে বসেন। আমি অন্য কোথাও যেয়ে বসি। প্রথমেই তার মিলির পাশের খালি সিটে চোখ পড়লো। কোন সংকোচ ছাড়াই যেয়ে বসলেন।

এই দৃশ্য ক্লাসের সবাই দেখলো। দুষ্টু রুবেল এসে সারের অগোচরে ছবি তুলে ফেললো।

১২

বিয়ের পর থেকে বেশ কয়েক বছর জয়নাল আর মিলি আনন্দের বন্যায় ভেসেছিল। বিয়ের এক দিনের মাথায় মিলি জয়নালকে নতুন নাম দিল জয়। একজন অন্যজনকে ছাড়া থাকতে পারছিল না। মিলির পড়ালেখার সময় জয়নাল পাশে বসে থাকতো। মিলি চেয়ার থেকে উঠলেই জয়নাল গান ধরতো –one for sorrow, two for joy। একা থাকলেই কষ্ট, দু জন হলেই আনন্দ।

এর পরে জয়নালের আর তর সয় না। দুটো জোড়া ঠোট একেবারে আঠার মত লেগে যায়। পর্যায়ক্রমে একজনের শরীর অন্যজনের সাথে মিশে যেতে চায়। দু জনেরই প্রতিটা অঙ্গ; অন্য জনের প্রতিটা অঙ্গের জন্যে অস্থির হয়ে কাঁদতে থাকে। শেষে এই কান্না পরিণত হয় সুখের ধ্বনিতে: চরম সুখের।

স্বপ্নের বুনন চলতে থাকে। মিলির স্বপ্ন চেম্বার, ক্লিনিক, হাসপাতাল। জয়নাল বলে, তোমাকে আমি সব করে দিবো, শুধু আমাকে তুমি একটা ছোট হাত পা ওয়ালা মানুষ উপহার দাও।

দু জনের স্বপ্নই পূরণ হলো।

মিলিই ওদের মেয়ের নাম রাখল জয়া। বলল, আমার ভালবাসা সৃষ্টি করেছে আরও দুটো ভালোবাসা, জয় আর জয়া। জয়নাল দেশের জমি বিক্রি করে মিলিকে ক্লিনিক বানিয়ে দিলো।

১৩

মেয়েদের যে দুটোর বেশী চোখ থাকতে পারে, মিলি সেটা আগে তেমন বুঝে উঠতে পারে নি। সে ঠিকই ধরতে পারলো এনাটমি ক্লাসের লেকচারের ফাঁকে ফাঁকে শায়েখ সারের চোখ তার সারা শরীর চষে বেড়ায়। কখন পায়ের দিকে, কখন হাতের আঙ্গুলের দিকে, কখন চট করে বুকের উপরে যেয়ে থামে। সেটা পিকনিকের থেকে ফিরে আসার কিছু দিনের মধ্যে পরিষ্কার হয়ে গেল।

এই দিকের কলেজে এমন কেও বাকী থাকল না, যে রুবেলের তোলা শায়েখ সার আর মিলির ছবি দেখল না। ছাত্রছাত্রীরা তো দেখলই, সব টিচারদেরও দেখা হয়ে গেল। একেক জনের একের ধরণের মন্তব্য। কেও বলল সার একটু বেশী বাড়াবাড়ি করেছে, কেও বলল সার ওকে ঘুম পারাল কি করে? কিন্তু মিলির মন জুড়িয়ে দিলো রুবেলের কথায়, ওদের দু জনকে পাশাপাশি কিন্তু দারুণ মানিয়েছিল।

ছবি নিয়ে কানা ঘুষা শায়েখ সারের কানেও গেল। ছবিটা তারও দেখা হলো। কেমন যেন একটা টান আর মোহ সৃষ্টি তৈরি হয়ে গেল। পুরুষ মানুষের মেয়েদের নিয়ে মোহের বেশীর ভাগটাই তো কাছে পাওয়া আর শরীরটাকে চেখে দেখার। এর জন্যে বেশী দিন অপেক্ষা করতে হলো না।

মিলিই একদিন এলো সারের রুমে এনাটমির কিছু কঠিন প্রশ্ন নিয়ে।

১৪

বিয়ের তিন দিনের মাথায় জয়নাল ও মিলি নেপালে হানিমুন করতে গেল। পাহাড়, নদী আর আকাশের এক নয়নাভিরাম সৌন্দর্য। মানুষ আর প্রকৃতি মিলে যেন একাকার হয়ে যায়। ভিতরের সব কিছু অবলীলায় বের হয়ে আসে। সব সত্য, সব স্বপ্ন কেমন আবেগের মত বের হয়ে আসে।

মিলি বলল, তার আর শায়েখ সারের উপাখ্যানের কথা। জয়নাল অবাক সব কথা শুনলো। কেমন একটা স্বগোক্তি করার মত করে বলল, ব্যাটা বদমায়েশ টিচারকে তুমি তোমার শরীর ধরতে দিলে? আমি কিন্তু আমার মন, শরীর—দুই তোমার জন্যে অনেক যত্নে save করে রেখেছিলাম। তার পরে জয়নাল কেমন যেন শান্ত হয়ে গেল। বাইরের জানালা দিয়ে দূরের আকাশ আর পাহাড় দেখতে লাগল। মুখটা যে ভারাক্রান্ত হয়েছে মিলি সেইটা সহজেই বুঝল। মনে হলো জয়নাল যেনো বিড়বিড় করে নিজেকেই নিজে বলছে, না এ হতে পারে না। এইটা অসম্ভব।

যৌবনের প্রচণ্ড চাহিদায় জয়নালের বিষয়টা ভুলে যেতে বেশী সময় লাগল না। মিলি এসে পেছন দিক থেকে জয়নালকে জড়িয়ে ধরলো। সারা শরীর হাত বুলিয়ে দিলো। তার পরে ঘাড়ে ঠোটের ছোঁয়া দিল। কানের লতিতে ছোট একটা কামড় দিয়ে বলল, আমাকে মাফ করে দাও। এখন থেকে আমার মন, শরীর, ভালোবাসা সব তোমার। ওই ব্যাটাকে আমি ঘেন্না করি। ও আমাকে ঠকিয়েছে।

ওরা দুজন শরীরের সুখ পেতে লাগল। মাত্রা বাড়তে বাড়তে সব চেয়ে উঁচুতে পৌঁছে গেল। শেষে ক্লান্ত হলো দু জন। মনে হল এক জনের সব সুখ বুঝি সবটুকুই অন্য জনের কাছে। এত দিন যে তারা কিভাবে একজন আরেকজন ছেড়ে ছিল? মিলি কানে কানে বলল, আমি তোমার জন্যে সব কিছু করতে পারি।

জয়নাল রসিকতা করে বলল, যদি আমি আরেকটা মেয়েকে.........

মিলি বলল, আমি বিনা প্রতিবাদে স্বামীর মর্জিতে রাজী। জয়নাল লজ্জা পেলো, ছি তাই কি হয়? মিলি হাসতে হাসতে বলল, তোমার জন্যে আমি সব কিছু করতে পারি।

আমি তো বলেছি, আমার অনেক সাহস।

১৫

দিলরুবার সাথে ফোন রেখে মিলি মহা চিন্তায় পড়ল। এইটা কি করে সম্ভব, জয়নাল তার প্রিয় বোনকে চিনতে পারছে না। সে একেবারে নিশ্চিত জয়নাল বোনের সাথে রসিকতা করবে না। জয়নাল টুথ ব্রাশের রং মনে রাখতে পারছে না। সেদিন শুক্রবারে টেবিলে বসে ছিল---নিশ্চয়ই হকার যে দরজার নীচে পত্রিকা রেখে যায়, সেটা সে মনে করতে পারছিল না।

ঘর থেকে বের হবার সময় তার দিকেও কেমন করে তাকিয়েছিল। নিজের বউকেও চিনতে পারে নি; না কি? ডাক্তারি আরম্ভ করার পর থেকে আসলে জয়নালকে তেমন একটা এ্যাটেনশান দেওয়া হয় না। মেয়ে জয়া আর চাকরি নিয়ে তুমুল ব্যস্ততা। অবশ্য গত তিন বছর ধরে জয়া এমেরিকায় আছে। পড়ালেখা করছে, হেলথ ম্যানেজমেন্টে এমবিএ। দেশের থেকে বিবিএ করে গেছে। ফিরে এসে মায়ের হাসপাতালের হাল ধরবে। তা ছাড়া জয়নালকে দেশে আর বিদেশে প্রচুর ট্যুর করতে হয়েছে। দু জনের এক সাথে তেমন সময় কাটানোর সুযোগ হয়নি। একই ছাদের নীচে বসবাস হলেও দু জনের দু ভুবনে বসবাস। কারোরই অন্যজনের জগতের খবর নেয়া হতো না।

মাঝে বছর দুয়েক জয়নালের চাকরি ছিল না। সেই প্রথম মিলি দেখল জয়নাল বেশীর ভাগ সময় মন খারাপ করে বসে থাকে। তার সাথে কারণে, অকারণে কথা বলার চেষ্টা করে না। কাছে এসে ছোঁয়ার, ধরার চেষ্টা করে না। মিলি বুঝল, তার এখন উচিৎ স্বামীর পাশে যেয়ে দাঁড়িয়ে সাহস দেয়ার। কিন্তু তার সময় কোথায়? বাসায় থাকলে মেয়ে জয়ার সেবা যত্নের তদারকি করতে হয়। রুগীদের ফোন আসতে থাকে। কখনো কখনো রুগী দেখতে ছুটতে হয়।

বেচারা স্বামীকে সময় দেবার সময় কোথায়?

১৬

শায়েখ সার খুব সহজেই সাহসী একজন মেয়েকে স্বপ্ন দেখালো। দু জনেরই একই পেশার হবে; অনেক ভবিষ্যতের কথা বললো। মিলিও বিগলিত হলো। ধরা দিলো সারের কাছে। সার গোপনে যে সব অঙ্গে চোখ বুলাতো, সেখান হাত দিয়ে স্পর্শ করলো। উত্তেজনা হলো দু পক্ষেই। মিলনের বাজনার অন্তরা বেজে উঠলো।

সম্পর্ক হওয়ার তিন মাসের মধ্যে মিলি একদিন কলেজে এসে শুনলো, সার দু সপ্তাহের ছুটি নিয়ে দেশে গেছে। মিলি অবাক, তাকে না বলে দেশে গেছে। নিশ্চয়ই গ্রামের বাড়িতে কোন বড় ধরণের সমস্যা হয়েছে। মিলি লোক মুখে খবর পেলো, শায়েখ সার মায়ের পছন্দমত একটা মেয়েকে বিয়ে করেছে। মিলি ভেবেই পেলো না, এইটা কি করে হতে পারে।

শায়েখ সার এসে বলল, বিয়ে করেছি তো কি হয়েছে? ও গ্রামের মেয়ে, ঘর সংসার দেখবে। আর তুমি হবে আমার আউট সাইড ডার্লিং। চাও তো তুমিও আরেকটা বিয়ে করে হাসবেন্ড বানাতে পারো। আমার কোন যায় আসে না। মিলি উত্তর দিলো, কি কি বললে, তুমি আমাকে রক্ষিতা বানাতে চাও? সার মীন মীন করে বলল, ও রকম না ভাবলেই হয়।

পরের দিন ক্লাসে সবার সামনে মিলি আবার একটা সাহসী কাজ করলো।

মিলি শায়েখ সারের মুখে থু থু ফেললো। তার পরে ডান গালে দিলে এক থাপ্পড়।

১৭

মিলি হাসপাতালের মিটিং ক্যান্সেল করে দিলো। মন বসলো না কোন কিছুতেই। ফোন করলো দেশের এক জন বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী প্রফেসর ফজলুল রশিদকে। তার সাথে বিভিন্ন মিটিং, ফাংশনে দেখা হয়। বেশ অন্তরঙ্গতাও আছে। তিনি মনোযোগ দিয়ে মিলির কথা শুনলেন।

প্রফেসর ফজলুল রশিদ একটা দম নিয়ে বলতে লাগলেন, মনে হচ্ছে আপনার হাসবেন্ড সম্ভবত ডিমেনশিয়া (Dimentia) রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। এতে প্রথমে স্মৃতি শক্তি এলোমেলো হয়; ফিরে আসে, আবার হারিয়ে যায়, কথা বার্তা, চিন্তা ভাবনার ধারাবাহিকতা নষ্ট হয়। ভাল, মন্দ, ন্যায়, অন্যায়ের বাচ বিচার করার ক্ষমতা লোপ পেতে থাকে। আবার অনেক সময় পার্মানেন্ট মেমোরি লস পর্যন্ত হয়।

মিলি জানতে চাইল, কেন এ রকম হয়? প্রফেসর বললেন, এই ভাবে তো বলা মুশকিল। কারো হয় জেনেটিক কারণে, আবার অনেক মানুষের ডিপ্রেশন - হতাশার কারণেও হতে পারে। মস্তিষ্কের কোন জায়গা, কতটুকু আক্রান্ত হয়েছে তার উপরে নির্ভর করে, মস্তিষ্ক স্মৃতিকে প্রয়োজনের সময় কতটুকু রিট্রিভ মানে ব্যবহার করতে পারবে। তবে আশার কথা হলো রোগটার কিছু চিকিৎসা আছে। আপনি আপনার হাসবেন্ডকে নিয়ে আসেন। দেখি তার জন্যে কি করা যায়।

মিলি ইন্টারনেট ঘেটে রোগটা সম্পর্কে আরও অনেক কিছু জানলো। কিন্তু জয়নালের তো এতো তাড়াতাড়ি এই সমস্যা হওয়ার কথা না। সে তো মাত্র পঞ্চান্ন হবে।

তার মানে জয়নাল, তার জয় তাকে এখন নাও চিনতে পারে!!

১৮

বাবার অসুস্থতার কথা শুনে মেয়ে জয়া জানালো, আমি এই সেমেষ্টার শেষ করেই করেই দেশে ফিরবো। বাবা সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত আমি কোথাও যাব না। আমি দেশে থাকলে, বাবার এতো ডিপ্রেশন হতো না। এ রকম খারাপ অসুখ হত না। মাকে কঠিন স্বরে বলল, তুমি পাশে থেকেও আমার বাবাকে সময় দাও নি। শুধু নিজের প্রফেশন নিয়ে লেগে থেকেছ।

আসলে মিলির কাছে কোন উত্তর ছিল না। লোকটা তো তার সব কিছু মেনে নিয়েছিল। তার আগের জীবন নিয়ে কখনও একটা কথা বলে নি। সে হয়তো আর পাঁচ জনের মত কিছু ভালোবাসা চেয়েছিল। এক সাথে কিছুটা ভাল লাগার সময় কাঁটাতে চেয়েছিল। এটা মানুষের ন্যুনতম চাওয়া, হয়তো অধিকারও। কিন্তু বাইরের জগত তাকে জয়নালের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল। এখন মনে হচ্ছে, ভালোবাসার গোলাপ কিভাবে যেন শুকিয়ে ঝরে গেছে। আর সে নিজে একজন ডাক্তার হয়ে কি না বিষয়টা বুঝতে এত সময় নিলো। ছি ছি!!

এই দিকে জয়নালের রোগটা জটিল হতে থাকলো। কিছু কিছু দিন সে আশেপাশের বেশীর ভাগ মানুষকেই চিনতে পারে না। কোন দিন শুধু অতীতের ঘটনা মনে করতে পারে, কখনও আবার সেই ছোট বেলায় পৌঁছে যায়। সারা বাড়ি ধরে মাকে খুঁজতে থাকে। বলে, মা স্কুলে যাব, তাড়াতাড়ি ভাত দাও। কিন্তু জয়নালের মা মারা গেছে সেই কবে; আজ প্রায় পনের বছর হয়ে গেছে।

মিলি ফোন করলো মেয়ে জয়াকে। মা আমার জন্যে একটা জিনিস আনতে হবে। কিন্তু খবরদার কাওকে বলবি না। তুই আমার জন্যে একটা.........।

জয়া অবাক হয়ে ফোনের ওই দিক বলল, মা এইটা তুমি কি বললে, ওই জিনিষ দিয়ে তুমি কি করবে?

মিলি জয়াকে কিছু বলল না।

ফোন রেখে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিজেকে নিজে বলল, মিলি এখনও প্রচণ্ড সাহসী।

১৯

মিলি ইদানীং তেমন একটা হাসপাতালে যায় না। ফোনে কাজ চালিয়ে নেয়। জয়নালকে মনে হয় ছোট একটা শিশু। বেশীর ভাগ কাজ ধরে ধরে করাতে হয় কিংবা করে দিতে হয়। জয়াকে দেখেই বলল, তুমি কোথায় ছিলে মা? সারা বাড়ি খুঁজে পাই না। তাড়াতাড়ি ভাত দাও। আজকে স্কুলে দেরী হয়ে যাবে।

অনেকেই বলে জয়ার চেহারা অনেকটা তার দাদীর মত। হয়ত জয়নাল মনেই করতে পারে না, তার একটা মেয়ে আছে। তার নাম জয়া। মেয়েকে মা ভেবে সম্ভবত ভুল করছে।

তবে মেয়ে তো মা হতেই পারে!

২০

মিলি ভীষণ একটা দুঃসাহসিক কাজ করলো। জীবনে কাজটা সে আরেক বার করেছে। এইটা দ্বিতীয়বার। বিদেশী সংক্ষিপ্ত ঘুমের পোশাক পরে জয়নালকে আদর করে করে ঘুম থেকে তুললো। জয়নালের মুখ বুকের মধ্যে চেপে ধরল।

আজ বহু বহু বছর পরে দুটো শরীর এক হলো। উন্মাদের মতো এক জন আরেক জনের মধ্যে হারিয়ে গেল। মিলি আনন্দের আতিশয্যে বলল, জয় আমার জয়।

কথাটা শুনে জয়নাল একেবারে জড়সড় হয়ে বসলো। মিলি বলল, কি কি ব্যাপার?

জয়নাল নিচু লজ্জিত গলায় বলল, আমার যে বউ মিলি, সেও খুব সাহসী। আমাকে বলেছিল, আমার একটা গোপন ইচ্ছা সে পূরণ করে দিবে। আপনি যেই পোশাক পরেছেন, সেও বিয়ের রাতে এই পোশাক পরেছিল। সে-ও কিন্তু আমাকে জয় বলে ডাকত।

মিলি কাঁদতে কাঁদতে উত্তর দিলো, আমি ও খুব সাহসী।

সেপ্টেম্বর ২৮, ২০১৩

কাজী হাসান

প্রবাসী লেখক : quazih@yahoo.com