চটপটি এন্ড ফুচকা বৃত্তান্ত
আসুন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা পার্কের গেটের সামনের একটা দৃশ্য কল্পনা করি। একজন স্ট্রিট ভেন্ডর কার্টের একদিকে দাঁড়িয়ে কিছু একটা তৈরি করছে আর তার চারিদিকে ঘিরে আছে একদল তরুণী-কিশোরী-সুন্দরী। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই তাদের সঙ্গীগুলো আশে পাশেই কিছুটা মলিন চেহারা করে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের মুখমণ্ডলের এমন করুণ দশা হওয়ার কারণটা না হয় একটু পরে বলি। যাই হউক ফিরে আসি প্রসঙ্গে। একের পর এক ক্রেতার দল তাদের চাহিদা জানিয়ে চলেছে। হকার মহোদয় নিপুণ হাতে ফরমায়েশ অনুযায়ী প্রস্তুত করে প্লেট ভর্তি খাবার সুন্দরীদের হাতে তুলে দিচ্ছে। হাতে প্লেট পাওয়া মাত্রই কাস্টমারদের আনন্দে চোখ-মুখ জ্বলজ্বল করে উঠছে। কয়েক জনের আবার জিহ্বার পানি বুঝি মুখ গড়িয়ে বাইরে চলে আসে। না ক্রেতার আর তর সয় না। কোনো রকমে একটু সরে দাঁড়িয়ে মুখের মধ্যে গপাগপ খাবার চালান দিতে থাকে। খাওয়ার সময়ে মুখ যত নড়ছে, চোখ মুখ দিয়ে সন্তুষ্টির ঝিলিক তার থেকে দ্বিগুণ মাত্রায় বের হয়ে আসছে!
আচ্ছা এখন না হয় একটা প্রশ্ন করি। বলুন তো উপরের বর্ণনায় স্ট্রিট ভেন্ডর বা হকার কি খাবার বানিয়ে সুন্দরীদের দিচ্ছে? আমি নিশ্চিত আমার সু-প্রিয় পাঠিকা বান্ধবীরা বর্ণনার প্রথম লাইনে ধরে ফেলেছেন, আমি কি নিয়ে কথা বলছি। হয়তো ইতিমধ্যে তাদের মানসপটে খাবারটা এসে হাজির হয়ে গেছে এবং খুব সম্ভবত জিহ্বায় পানি পর্যন্ত চলে এসেছে। আর এখনও যারা প্রসঙ্গ ধরতে পারেন নি, তাদেরকে জানাই আমি বলছি লোভনীয় চটপটির ও তার সাথে ফুচকা পরিবেশনার কথা। বাঙালি রমণীদের মধ্যে এর জনপ্রিয়তা সব সময়ই তুঙ্গে। তবে ইদানীং দেখা যায় পুরুষ সমাজের কিছু সদস্য চটপটি, ফুচকার মাহাত্ম্য বুঝা আরম্ভ করেছে। তারাও সঙ্গিনীদের সাথে সমান তালে গোগ্রাসে এই খাদ্য পাল্লা দিয়ে খাচ্ছে। তবে চটপটি বানানোর প্রস্তুত প্রণালী একেবারে সহজ হলেও ঘরে তৈরি করলে সেই স্বাদটা ঠিক না-কি আসে না। তারপরেও ইদানীং নামী-দামী জায়গাগুলোর অনুষ্ঠানেও ঝকঝকে থালা-বাসনে চটপটি পরিবেশনার চল শুরু হয়েছে। কিন্তু চটপটি রসিকদের কাছে হকারদের হাতে রান্না-ই অনেক বেশী আকর্ষণীয়।
চটপটি বানাতে কী লাগে? একেবারে সামান্য কয়েকটা উপাদান। ছোলা, আলু, পিঁয়াজ দিয়ে একসাথে পানিতে ঘন করে সিদ্ধ করে তার উপরে পিঁয়াজ-মরিচ কুচি আর কিছু কাঁটা বয়েল ডিমের কয়েক পিস যোগ করলেই হয়ে যায় চটপটি। ও আসল কথা তো বলাই হয় নি। সাথে যোগ করতে হবে তেঁতুল দিয়ে তৈরি করা টক পানি। ফলে স্বাদে চটপটি হয়ে যায় প্রচণ্ড ঝাল ও টক। ফুচকার মধ্যে দিয়ে খেলে একবারে মচমচ করে চিবিয়ে খাওয়া যায়। চটপটি প্রেমিকদের কাছে পাল্লা দিয়ে চটপটি খাওয়াটা অনেকটা স্বর্গীয় অনুভূতির কাছাকাছি। কিন্তু প্রস্তুত প্রণালী এতো সহজ হলেও, চটপটি যে বানায় তার হাতের একটা বিশেষ কেরামতি থাকে। সেইজন্যই কার্টের পাশে দাঁড়িয়ে হকারের বানানো চটপটি হয় অনন্য। টেস্টের দিক থেকে বাড়ি কিংবা রেস্তোরাঁয় বানানো চটপটি এগুলোর আশে পাশে ভিড়তে পারছে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হল, ইডেন কলেজের সামনে চটপটি ওয়ালাদের ঘিরে মানুষজন বিশেষ করে মেয়েরা গম গম করতে থাকে। এখন অবশ্য এই দৃশ্য তো সারা দেশ জুড়ে। ঘর থেকে বের হয়ে একটু এগুলেই পাওয়া যায় চটপটি-ফুচকার কার্ট। অনেক সময়ে দেখা যায় হকার হয়তো এমন জায়গা তার ব্যবসার জন্যে বেঁছে নিয়েছে, যার থেকে স্বল্প দূরত্বেই আছে কোনো ড্রেন অথবা নর্দমার লাইন। তা ছাড়া থালা বাসন অপরিষ্কার পানি দিয়ে নামকে ওয়াস্তে ধুয়ে পরের ক্রেতার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। কিন্তু তাতে কি যায় আসে? চটপতি-ফুচকা প্রেমীদের স্বাস্থ্যবিধি লঙ্ঘন হচ্ছে কি-না সেটা নিয়ে মাথা ঘামানোর ফুরসুরত উপস্থিত কারোরই নাই। তাদের কাছে স্বাদটাই মুখ্য। ইদানীংকালে আবার কিছু কিছু সৌখিন চটপটি ওয়ালা তাদের কার্টের চারিদিকে কাস্টমারদের বসার জন্য আরাম কেদারা মানে চেয়ার পেতে রাখে। পাশে রাস্তার দিয়ে অসংখ্য গাড়ি কালো ধুঁয়া উড়াতে উড়াতে চলে যায়। সংলগ্ন জায়গাটার ধুলা-বালিরই বা কি দোষ? মানুষের পদচারনা ও চলন্ত গাড়ির চাকার সংস্পর্শ পেয়ে ধুলা-বালি বাতাসে উড়তে বাধ্য হয়। তবে নির্ভীক চটপটি প্রেমিকরা এইসব বিন্দু মাত্র কেয়ার করেন না। চটপটি ওয়ালার দক্ষ হাতে তৈরি চটপটির সাথে কার্টে রাখা মসলা-দানির কাঁচা মরিচ কুচি, পেঁয়াজ কুচি, শুকনা মরিচের বীজ ভাজা, লবণ, চিনি, গুঁড়া মরিচ ও তেঁতুলের পানি মিশিয়ে নিজের জিহ্বার মানানসই চটপটি পাওয়াতে তারা মহা-তুষ্ট। শেষে তারা রসনা তৃপ্ত করে মহা-আনন্দের ঢেকুর তুলে প্রস্থান করে।
চটপটিতে কিছু বৈচিত্র দিতে পারেলে কিন্তু একেবারে ফাটাফাটি সুপার হিট। একটা উদাহরণ দেই। এখনকার দিনের ঢাকার অন্যতম সেরা চটপটি ও ফুচকা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নাম হলো ‘জুম্মন মামার ফুচকা ও চটপটি।’ আরমানিটোলায় অবস্থিত বিখ্যাত তারা মসজিদের পাশেই তার কারবার। মামা টক হিসেবে ফুচকায় মেশান বোরহানি। ব্যস আর যায় কোথায়? এইটুকুতেই ব্যবসা একেবারে রমরমা। রীতি-মতো ফোন করে চটপটি ও ফুচকার অর্ডার দিয়ে এপোয়েন্টমেণ্ট নিতে হয়। !
চার বছরের পিঙ্কি জানতে চাইলো, “মা, ছোট পিপড়া খেতে কি খুব মজা? মা বিরক্ত হয়ে গম্ভীর সুরে উত্তর দিলেন, “খাবার সময়ে এই সব কি যাতা প্রশ্ন করছো?” পিঙ্কি বকা খেয়ে চুপ করে গেল। খাওয়া শেষ হওয়ার পর মা’র পিঙ্কিকে বকা দেওয়ার জন্য বেশ অনুতাপ হলো। তিনি পিঙ্কির কাছে এসে খুব নরম করে জানতে চাইলেন, “তুমি পিপড়া নিয়ে কি যেন প্রশ্ন করেছিলে?” পিঙ্কি বয়সে কম হতে পারে কিন্তু আত্মসম্মান নেহায়েত কম না। সেও মায়ের মতো গম্ভীর গলায় উত্তর দিলো, “তখন দেখলাম তোমার চটপটির প্লেটে ছোট একটা পিপড়া। আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে সেইটা তুমি চপচপ করে খেয়ে ফেললে।” বুঝলেন তো বিষয়টা? সুন্দীরা চটপটি-ফুচকা পেলে একেবারে আরেক জগতে চলে যায়। আরেকটা গল্প বলি। সন্ধ্যা পার হয়ে অন্ধকার হয়ে গেছে। চটপটি ওয়ালা দোকান বন্ধ করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন ঠিক সেই রকম সময়ে বেশ কয়েকজন কাস্টমার চলে এলো। এ রকম ঝামেলার মধ্যে এক ষোড়শী সুন্দরী এসে আহ্লাদী গলা করে বলল, “মামু আমার চটপটি খেতে ভীষণ ইচ্ছা করছে, আমাকে একবারে দু প্লেট চটপটি দেন।” মামু উত্তরে বললেন, “আমার কাছে বেশী চটপটি নাই। আমি কারোর কাছে এখন এক প্লেটের বেশী বিক্রি করতে পারবো না। লাইনের সবাইকে তো দিতে হবে।” বেচারি ক্রেতা এক প্লেট চটপটি নিয়ে হাপুস হুপুস করে খেয়ে ফেলল। তারপরে প্লেটের উচ্ছিষ্ট ফেলতে গিয়ে হাতের থেকে দুটো পাঁচ শ টাকার নোট গারবেজ ফেলার ড্রামটার মধ্যে পড়ে গেল। মেয়েটা সাথে সাথেই আধ-অন্ধকারে ময়লার বাক্স উল্টে-পাল্টে তার পড়ে যাওয়া নোট দুটো খুঁজতে লাগলো। ওইদিকে চটপটি-ওয়ালা ভীষণ ব্যস্ত হলেও তার চোখে পড়ল মেয়েটার কর্মকাণ্ড। ব্যবসায়ী মানুষ সাথে সাথে পরের কাস্টমারকে বাদ দিয়ে হাতের প্লেটটা নিয়ে মেয়েটার কাছে যেয়ে বলল, “আপা আপনার চটপটি যে এতো ভালো লাগে সেটা বুঝতে পারি নি। আপনার ময়লার মধ্যে থেকে অন্যের ফেলে দেয়া জিনিস খাওয়ার দরকার নাই। আপনি এই ফ্রেস প্লেটের চটপটি খান। এর জন্যে কোনো দাম দেওয়ার দরকার নাই।”
ওই যে লেখার প্রথম দিকে বলেছিলাম, চটপটি কার্টের আশে পাশে পুরুষ প্রজাতির কিছু সদস্যদের গোমড়া মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। এইবার না হয় তাদের বেজার হওয়ার কারণটা বলি। একজন স্ট্রিট ভেন্ডর চটপটি-ওয়ালা কি নিপুণহাতেই না কাজ সম্পাদন করতে পারে! সে আরেকটু টক কিংবা ঝাল অথবা বাড়তি পেঁয়াজ দিয়ে অনবরত বাংলাদেশের অনিন্দ্য সুন্দরী কাস্টমারদের একের পর এক সন্তুষ্ট করে চলেছে। আর অন্যদিকে বড় বড় প্রেমিক-বররা শুধু একজন সঙ্গিনীর হাসি ধরে রাখতে জীবনপাত করে ফেলেও খুব বেশী সুবিধা করতে পারছে না। এখন আপনারাই বলেন, চোখের সামনে চটপটিওয়ালার এমন অসামান্য কার্যক্রম প্রত্যক্ষ করে ওইসব যুবকদের মুখ গোমড়া হওয়াটা কি খুবই অস্বাভাবিক?
জুন ৬, ২০১৯
কাজী হাসান
লেখকঃ quazih@yahoo.com