ধ্রুব তারা
১৯৭১ সাল। এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি।
একেবারে অজ গ্রাম রহিমপুর। যশোর থেকে যেই রাস্তা বেনাপোলের দিকে চলে গেছে, তার থেকে ছোট একটা রাস্তা নেমে গেছে ঝিকরগাছার দিকে। সেখানকার যেই বাজার, সেখান থেকে পায়ে হেটে রওয়ানা দিলে রহিমপুরে পৌঁছাতে ঘণ্টা খানেক লেগে যায়। যানবাহন বলতে শুধু গরু গাড়ি। তাও আবার গাড়োয়ালরা বেশীর ভাগ সময়ে ওই দিকে যেতে চায় না। ঝিকরগাছা থেকে যাত্রী নিয়ে গেলে, বেশীর ভাগ সময়ে খালি ফিরে আসতে হয়। তাই তারা হয় ডবল দাম চেয়ে বসে, না হয় বলে ওইদিকে যাবে না। সেই জন্য যুবা বয়সীরা ঝিকরগাছায় বাস থেকে সোজা হেঁটে রহিমপুরে চলে যায়।
গ্রামটাতে শহরের কিংবা দূরের মানুষ দেখা যায় না বললেই চলে। সেখানে তেমন বিশেষ কিছু নাই, যে কারোর ওখানে যাওয়ার দরকার হতে পারে। অবশ্য গ্রামের কিছু মানুষ কাজের জন্য আশে পাশে থানা কিংবা শহরে ছড়িয়ে পড়েছে। তারা তাদের আত্মীয়স্বজনদের দেখতে কালে ভদ্রে গ্রামে ফিরে আসে। আবার এই গ্রামের যারা অন্য জায়গায় বিয়ে করেছে, তাদের কুটুমরাও আসে। গ্রামে উত্তেজনা বলতে এই। তা ছাড়া গ্রামটা একেবারে গতানুগতিক। সকাল হলে পুরুষরা খেত খামারে যায়। বিকালে ফেরে। মেয়েরা ঘর সংসার সামলায়। গ্রামবাসীদের জীবন বৈচিত্র্যবিহীন বলা চলে।
সদরুল পাশা গ্রামের যে ছোট মসজিদে আছে, সেখানকার ইমাম। বয়সে একেবারে তরুণ। বিশের ঘরে বয়স। শুকনা, লম্বা, চোয়ালে হাতে গোণা কিছু দাড়ি। পরনে সব সময় পায়জামা, পাঞ্জাবি ও মাথায় কাপড়ের টুপি। বেশ রাত থাকতেই উঠে পড়ে। প্রথমে বাসায় তাহাজ্জদের নামাজ। তার পর মসজিদের উদ্দেশ্যে বের হয়ে পড়ে। ছোট এক চিলতে বেড়ার ঘর, টিনের ছাদ। চেয়ারম্যান সাহেব তার বাবার নামে এই মসজিদ বানিয়ে দিয়েছেন। মসজিদের সাইন বোর্ড শহর থেকে করিয়ে এনেছিলেন। বাংলা, উর্দু, আরবিতে লেখা আলহাজ্ব জব্বর মোল্লা মসজিদ। গ্রামবাসী বেশীর ভাগ নিরক্ষর হলেও সদরুল পাশা সুযোগ পেলেই সাইন বোর্ডের মাহাত্ম ব্যাখ্যা করেন। মাথায় কাজ করে চেয়ারম্যান সাহেব কেন যে তার নামটাও সাইন বোর্ডে দিয়ে দিলেন না, ‘ইমামঃ সদরুল পাশা।’
অল্প বয়স্ক, সম বয়স্করা তাকে দেখা মাত্রই শব্দ করে বলে উঠে আসসালামু আলায়কুম। ইমাম সাহেবও আর দেরী করেন না, আরও উৎসাহ নিয়ে উত্তর দেন, ওয়ালায়কুম উস সালাম। সাথে সাথে একটা আত্মপ্রাসাদও চলে আসে। সে নিজেই গ্রামে বিষয়টা প্রচলন করেছে। প্রথমে নিজে শিখালো কয়েকজনকে। তারপরে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়লো পুরো গ্রামে। তার ধারণা এই গ্রামের পরম করুণাময় সব সময়ে সবাই সবাইকে সালাম দেয়া কারণ একেবারে শান্তিপূর্ণ করে রাখবেন।
যাই হোক এই শান্তিপূর্ণ ও বৈচিত্র্যহীন গ্রামে একবারে অন্যরকম কিছুর আলামত প্রথম ইমাম সাহেবই পেলো। সে নিজের চোখে ভূত দেখলো ও নিজের কানে খেজুর বাগান থেকে ছোট বাচ্চার কান্নার শব্দ শুনলো।
২
আনোয়ারা খালাকে এক নামে অঞ্চলের সবাই চেনে। ষাটোর্ধ বয়স কিন্তু হাতা চলায় বেশ শক্ত। মনেই হয় না তার এত ব্যস হয়েছে। ছোট বড় সবাই খালা বলে ডাকে। বিধবা হয়েছেন সেই কবে, সেটা বেশীর ভাগ মানুষই মনে করতে পারে না। খুবই অল্প বয়সে বিধবা হয়েছিলেন। নিজের হাতে দু ছেলে, এক মেয়েকে বড় করেছেন। ছেলে দু জন গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে গেছে। শোনা যায় মায়ের সাথে তাদের বিশেষ কোন সম্পর্ক নাই; মাঝে মধ্যে হয়ত চিঠি পত্র দেয়। তবে মেয়ে ঠিকই খবর রাখে। দু গ্রাম পরে রঞ্জনপুর। সেখানে বিয়ে হয়েছে আজ প্রায় দশ বছর হতে চললো। বছরে দু একবার মাকে দেখতে আসে। সুযোগ পেলেই মায়ের জন্যে এটা সেটা পাঠিয়ে দেয়। গ্রামের মানুষরা বলে মেয়ে মায়ের জন্যে টাকা পাঠায়।
গ্রামের সবার জন্যে তার অগাধ ভালোবাসা। সারাদিন ধরে একের ভালো খবর অন্যদের দিয়ে বেরানোই তার কাজ। কার বাচ্চা হয়েছে, কার ছেলের শহরে চাকরি হয়েছে, কার গাছে ভাল কাঁঠাল এসেছে, কার ফসল ভাল হচ্ছে--এই জাতীয় সু সংবাদে তার ভাণ্ডার পরিপূর্ণ থাকে। কিন্তু কোন ভুল বুঝাবুঝি হয়, ঝগড়া হয়, ফ্যাসাদ হয় ধরণের কথা তার মুখ থেকে কেউ শুনে নি। শুধু তার ছেলেদের কথা জানতে চাইলে বেচারি চোখ ছল ছল হয়ে যায়। মাথা নিচু করে বলেন, “থাক ওদের কথা আর আমাকে বলো না।”
খালার সংসারে আর কেউ না থাকলেও, তার কিন্তু কাজের কোন ইয়ত্তা নাই। কাক ডাকা সকালে উঠা থেকে আরম্ভ করে সেই এশার নামাজ শেষ করে বিছানায় যাওয়া পর্যন্ত কাজ চলতেই থাকে। মেলা অসুখের কবিরাজি ওষুধ তার নখ দর্পণে। জ্বর, সর্দি, কাশি, পেটে ব্যথা হলেই মানুষ ছুটে আসে ওষুধ নিতে। আনোয়ারা খালা অবশ্য অন্য আরেকটা কাজের জন্যে সব চেয়ে বেশী নিজেকে গর্বিত অনুভব করেন। সেটা হল এক কথায় বলতে গেলে তিনিই হলেন গ্রামের প্রধান দাই।
গ্রামের বেশীর ভাগ বাচ্চা তার হাতে হয়েছে। আরও দু একজন মহিলা কাজটা পারে। কিন্তু সবার আস্থা আবার আনোয়ারা খালার উপরেই বেশী। যেখানে আনোয়ার খালা উপস্থিত, বাচ্চা প্রসবে মায়ের কষ্ট কম হবে বলে, সবাই ধরে নেয়। এমনকি খালাকে মাঝে মাঝে আশে পাশের গ্রাম থেকে মানুষ এসে নিয়ে যায়, “খালা আপনি না গেলেই না, মেয়ের পেট কেমন শক্ত হয়ে গেছে।” খালা বাচ্চা প্রসব করিয়ে ও কবিরাজি ওষুধ দিয়ে অল্প কিছু উপার্জন করেন। দরিদ্র মানুষরা টাকা পয়সা দিতে না পারলে বাগানের শাক-সবজি দিয়ে যায়। আবার কিছু মানুষ বাড়ির বাড়তি চালডাল পর্যন্ত এমনিতেই খালার জন্যে নিয়ে আসে। বিধবা মানুষ একা একা থাকেন, এই জন্যে সবার তার প্রতি একটা বিশেষ মায়া আছে। এই ভাবেই আনোয়ারা খালার নিঃসঙ্গ সংসার চলে।
পাশের গ্রাম থেকে ডাল এলো পরশু রাতে। গ্রামের মাতব্বরের ছেলের বউয়ের পেট নাকি ভীষণ শক্ত হয়ে গেছে। তিনি পাল্কি নিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছেন। সাথে এক গাদা মানুষ। খালাকে আবার এই দিকে আবার আরেক জন খালাকে খুব করে বলে রেখেছে। সিদ্দিক বাড়ির মেয়ে সখিনা। তার বাচ্চা যে কোন সময়ে হয়ে যেতে পারে। খালা’র হাতেই সখিনার জন্ম। সখিনা ও তার পরিবার অনুরোধ সানন্দে খালা গ্রহণ করেছিলেন। খালার ইচ্ছা ছিল সখিনার জন্যে গ্রাম ছেড়ে কোথাও যাবেন না। ডাক পড়লেই যাতে ছুটে যাওয়া যায়।
পাশের গ্রামের অনুরোধও খালা ফেলতে পারলেন না। বর্ণনা শুনে একবার বলেছিলেন, মনে হচ্ছে আমার পক্ষে কিছু করা হয়ত সম্ভব না। যশোর সদর হাসপাতালে নিতে হবে। ডাক্তারকে পেট কেটে বাচ্চা বের করতে হবে। কিন্তু তারা খালার কোন অজুহাত মানতে নারাজ। খালার উপরে তাদের আস্থা, তিনিই ঠিকই ডেলিভারি করিয়ে দিতে পারবেন। সেই যশোর নেবার হাঙ্গামার মধ্যে মেয়ের বাবা, জামাই যেতে চাচ্ছিল না।
প্রতিবেশী গ্রামের মানুষদের ধারণরাই জয় হয়েছিল। জটিল হলেও খালা ঠিকই বাচ্চা প্রসব করাতে পারলেন। তবে একটা না দুটো, মানে যমজ। এক জন ছেলে, অন্যটা মেয়ে। দু বাচ্চা থাকার কারণে পেটে কোন জায়গা ছিল না বললেই চলে। ভাগ্যিস খালা সময়মত পৌঁছাতে পেরেছিলেন। মেয়ে একেবারে কষ্ট নিতে পারছিল না। দু বার জ্ঞান হারিয়েছিল। খালা দক্ষ হাতে ভালই সামাল দিলেন। সারারাত ধরে প্রসব বেদনা চলল। শেষে খালার হাত দিয়ে এক এক করে দুটো বাচ্চা পৃথিবীর আলো দেখে চিৎকার করে কেঁদে উঠলো। বাড়ির সবাই মহা খুশী। কেউ খালাকে ছাড়তে চায় না। তার পরেও, বেলা বাড়ার আগেই খালা রাস্তায় নেমে পড়লেন। অবশ্য মাতব্বর সাহেব পাল্কি না হয় গরু গাড়ি দিতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু খালা জানালেন, ওইসবের কোন দরকার নাই। তার রাস্তা ভাল করেই জানা। তিনি ঠিকই একা পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরতে পারবেন। ফিরেই সখিনার বাসায় ছুটতে হবে। তার যে কোন সময়ে বাচ্চা হয়ে যেতে পারে। তাকে সেখানে থাকতেই হবে।
খালা গ্রামে ঢুকেই সরাসরি সখিনার বাসায় যেয়ে হাজির হলেন। মেয়েটার প্রথম বাচ্চা হচ্ছে। বাড়ীর সবাই অধীর হয়ে আছে। খালাকে দেখে সবাই মনে হয় হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। তিনি পরীক্ষা করে বুঝলেন, বেদনা আরম্ভ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু চাপ খুব কম। আগামী কাল সকালের আগে বাচ্চা বের হবে না। এদিকে তার শরীর ভীষণ ক্লান্ত। গত রাতে ছিলেন পাশের গ্রামে মাতব্বর সাহেবের মেয়েকে নিয়ে। তার বিশ্রাম না নিলেই না। শরীরটা একেবারে ভেঙ্গে আসছে। সখিনার পাশে তার মা ও দু খালা ছিল। আনোয়ারা খালা তাদের বুঝিয়ে দিলেন, সখিনাকে কখন কী কী সেবা দিতে হবে। তিনি এখন বাসায় যাচ্ছেন একটু জিরিয়ে আসবেন। ভোরের আজান হওয়ার সাথে সাথেই ফিরে আসবেন।
৩
ইমাম সদরুল পাশা অন্ধকার থাকতেই মসজিদের উদ্দেশ্যে বের হয়ে পড়ে। যাওয়ার পথে খালার বাসা পড়ে। গতকাল খালা খবর পাঠিয়েছিলেন, সে যেন খালাকে সখিনার বাসা পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। খালা সদরুলকে খুব স্নেহ করেন। মাঝে মাঝে রান্না করে পাঠিয়ে দেন। তার কাছে এই ইমাম তার নিজের ছেলেদের মত, তাদেরই বয়সের। সদরুলও খালাকে মায়ের মত সম্মান করে। কারণে অকারণে এসে খালার ভাল মন্দ খবর নিয়ে যায়। এটা সেটা কোন কাজ থাকলে করে দেয়। সে ভিন গ্রামের মানুষ হলেও খালার মধ্যে নিজের মাকে খুঁজে নেয়। যদিওবা নিজের মা মারা গেছে আজ প্রায় বছর পাঁচেক হল।
আনোয়ারা খালা ক্লান্ত হয়ে বিছানায় গেলেও, ঘুম কিন্তু বেশীক্ষণ স্থায়ী হল না। মাথার মধ্যে সব টেনশন কাজ করতে লাগল। বিছানা থেকে উঠেই সখিনার বাসায় যেতে হবে সদরুলের সাথে। তাকে কোনভাবে অপেক্ষা করিয়ে রাখা যাবে না। সদরুলকে ঠিক সময়মত মসজিদের যেয়ে আজান দিতে হবে, নামাজ পড়াতে হবে। মসজিদে ফজরের নামাজে বেশী মানুষ হয় না। তার পরেও যে কজন মানুষ আসে তাদের নিয়ে নামাজ পড়াতে হয়। ওইদিকে সখিনার যে কি অবস্থা। কাল রাতে ওদের বাসায় থেকে গেলেই হত। কিন্তু শরীরে বেশী ক্লান্তি চলে এসেছিল। তা ছাড়া নিজের বিছানায় না শুয়ে খালার ঘুম হয় না।
ভোর রাতের কিছু আগে খালার চোখ মাত্র কিছুটা লেগে আসার সাথে সাথেই মনে হল খালা স্বপ্ন দেখা আরম্ভ করেছেন। ছোট ছেলে কামাল উঠোনে বসে বসে কাঁদছে। চোখ লেগে থাকলেও মাথাটা ঠিকই কাজ করছিল। কামাল বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে আজ কত দিন হয়ে গেল। কত ইচ্ছা ছিল দুই ছেলেকে এক এক করে বিয়ে দিয়ে টুকটুকে বউ নিয়ে আসবেন। নাতি- নাতনিদের কোলাহলে বাড়িটা সব সময়ে ভরে থাকবে। আনোয়ারা খালা বাড়ির সবাইকে নিয়ে মেতে থাকবেন।
খালাকে সখিনার বাসা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে হবে, তাই ইমাম সদরুল হাতে সময় নিয়ে বের হয়ে পড়লো। বাইরেটা তখনো বেশ অন্ধকার। কিন্তু তার এ রকম অন্ধকারে মসজিদে যাওয়ার অভ্যাসটা ভালই আছে। মসজিদের কাজে তাকে মাঝে মধ্যেই অন্ধকার থাকতেই বের হয়ে পড়তে হয়। ফজরের পর পর একদল ছাত্রকে ঘণ্টা খানেক আরবি পড়াতে হয়। তাদের পরীক্ষা থাকলে আগে আগে যেয়ে পরীক্ষার খাতা গুছানোর একটা বাড়তি কাজ থাকে। প্রশ্ন পত্রে চোখ বুলিয়ে, শেষবারের মত দেখে নিতে হয় কোন ভুল আছে কি- না। গ্রামের কোন বিশিষ্ট মানুষের মসজিদে আসার কথা থাকলে, জলদি যেয়ে সব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করতে হয়।
সদরুল তাড়াহুড়া করে বের হয়ে পড়লো। কয়েক কদম যাওয়ার পর খেয়াল হল দরজায় তালা হয়ত দেয়া হয় নি। কিন্তু ফিরে যেয়ে সেটা দেখে আসার উপায় নাই, দেরী হয়ে যাবে। নিজেকে সান্ত্বনা দিল কেউ জানবে না যে দরজায় তালা দেয়া হয় নি। যদিওবা জেনে ফেলে ভিতরে ঢুকে, তা হলে চোর সাহেবকে ভীষণ হতাশ হতে হবে। দামী বা চুরি করার মত জিনিষ তেমন একটা পাবে না। নিজের কৌতুকে নিজেরই মুখে একটু মুচকি হাসি চলে এলো। দরজা তালা নিয়ে ভাবনা চলতে থাকলেও ইমাম সদরুলের কিন্তু হাঁটার গতি কমে নি।
৪
ইমাম সদরুল পাশা থেকে আনোয়ারা খালার বাসা পর্যন্ত যেতে সময় লাগে, মিনিট ৮ থেকে ১০। রাস্তায় কারোর সাথে দেখা হয়ে গেলে, কুশল বিনিময় করতে করতে আরও কিছুটা সময় পার হয়ে যায়। কিন্তু এত ভোর মানে দিনের আলো ফোঁটা আগে কারোর সাথে দেখা হওয়াটা একেবারে অস্বাভাবিক ব্যাপার। ইমাম মোটামুটি নিশ্চিত যে সে রকম হওয়ার সম্ভাবনা নাই। আজকে সে আরও কিছুটা আগে বের হয়েছে। খালার বাসা থেকে মসজিদ বেশ কাছে। মিনিট পাঁচেকের রাস্তা।
সদরুলের ইচ্ছা একটা হাত ঘড়ি কেনার। সে জন্যে বেশ কিছুদিন ধরে টাকা জমাচ্ছে। গতমাসে হয়ত কেনা হয়ে যেত; টাকাও মোটামুটি জমান হয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ মা খবর পাঠালেন, বড় বোন জোবেদার ছেলের আকিকা। পারলে কিছু টাকা পাঠাতে। মা টাকা চেয়েছেন। সদরুল আর দেরী করলো না; জমানো টাকা মায়ের জন্য পাঠিয়ে দিল। তার পর আবার নতুন করে টাকা জমাচ্ছে। ঘড়িটা কেনা হয়ে গেলে কিন্তু বেশ হবে। একেবারে কাটায় কাটায় আজান দেয়া, নামাজ পড়ানো থেকে আরম্ভ করে অন্যান্য কাজ সময়মত করা যাবে। এই অল্প সময়ের ইমাম সদরুলের মাথার মধ্যে কত কিছুই না খেলতে লাগলো।
খালার বাসার ঠিক লাগোয়া সলিমুদ্দিনের খেজুর বাগান। সারি সারি খেজুর গাছ। অবশ্য আম, কাঁঠাল, ডাব গাছ আছে। কিন্তু নাম হয়েছে খেজুর বাগান। প্রায় দু একর জায়গা জুড়ে। পায়ে হাঁটা রাস্তাটা বাগানের ধার দিয়ে চলে গেছে। ইমাম সদরুল সেই জায়গাটা পার হওয়ার সময় মনে হল কানে কিছু মানুষের ফিস ফিস কথাবার্তা কানে এলো। কিন্তু সেইটাই বা কি করে সম্ভব। অন্ধকার থাকলে মানুষেরা বাগানটা এড়িয়ে চলে। সেখানে সাপ খোপের একটা সমস্যা আছে।
প্রথমে ভাবল শুনতে ভুল হচ্ছে। সে প্রতিদিনই এই জায়গা দিয়ে হেঁটে যায়। কখন তো এ রকম হয় নি। ভাল করে শোনার চেষ্টা করল। ইচ্ছা করছিল বাগানটার ভিতরে ঢুকে একটু দেখে আসতে। কিন্তু হাতে একেবারে সময় নাই। হঠাৎ মনে হল, শব্দটা বন্ধ হয়ে গেল। সদরুল চিন্তাটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে জোড় কদমে এগিয়ে চলল। বাগানের শেষ মাথায় এসে অদ্ভুত একটা বিষয় হল। বাগানের ভিতর থেকে একেবারে ছোট এক বাচ্চার কান্নার শব্দ ভেসে আসতে লাগল। ভাবল, হয়ত বিড়ালের বাচ্চা, কোনভাবে বাগানের মধ্যে যেয়ে রাস্তা হারিয়ে ফেলেছে। এখন বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্যে কাঁদছে। পরের মুহূর্তে একটা ভয়ের কথা মনে হল। যদি জীন, ভূত হয়। সাথে সাথেই দোয়া পড়ার করার চেষ্টা করলো। আল্লাহ’র কালাম সাথে থাকলে ভয়-বিপদ থাকে না। কিন্তু আরেক সমস্যা হল, প্রয়োজনের সময় মাথাটা কেমন গুলিয়ে গেল। ঠিক করে কোনো দোয়া মনে এলো না। কি যেন দোয়াটা, ইউনুস নবী মাছের পেটে যেয়ে পড়েছিলেন।
আশে পাশে কেউ নাই। ঝেড়ে একটা দৌড় দিতে পারলে খুব ভাল হত। কিন্তু পা দুটো ভারী হয়ে গেছে, একেকটা পা যে পাঁচ মণের হয়ে গেছে। এ রকম হওয়ার কি কারণ হতে পারে? সে কি তা হলে ভয় পাচ্ছে? অবচেতন মন কি ভূত প্রেত সন্দেহ করছে। না সেইটা কি করে সম্ভব? সে আল্লাহ, রাসুলকে মেনে চলে। তা ছাড়া ভূত-পেত্নী বলে কিছু নাই। তবে জীন তো আছে! একটু আগে প্রথমে শুনলো মানুষের কথা বার্তা। তার পরে বাচ্চার কান্না। এইগুলো কিসের আলামত? জীনরা কি সলিমুদ্দিনের খেজুর বাগানে আস্তানা গাড়ল? ওরা না গোরস্তানের আশে পাশে থাকে।
হঠাৎ মনে হল পায়ের জোড় কিছুটা ফিরে এসেছে। আর দেরী করলো না, সদরুল দিল এক ছুট। মনে হল পিছন থেকে কেউ ডাকছে, এই যে মিয়া ভাই একটু শুনেন। কিন্তু সদরুল ভুল করেও পিছনে ফিরে তাকাল না। শেষে যদি আবার কিম্ভুত কিমাকার চেহারার কিছু দেখে ফেলে। হাঁপাতে হাঁপাতে পৌঁছে গেল আনোয়ারা খালার বাসার আঙ্গিনায়।
কিন্তু সেখানেও বড় ধরণের একটা বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। সেটা ভূত দেখার থেকে কোন অংশে কম না।
৫
দু ভাই জলিল আর কামাল। জলিল বছর তিনেকের বড়। সব সময়ে ছোট ভাই কামালকে আগলে রাখে। সারা গ্রাম জুড়ে দৌড়া-দৌড়ি, খেলাধুলা করে বেশ ভাল ভাবেই বেড়ে উঠছিল। সকালে পায়ে হেঁটে দু গ্রাম পাড়ি প্রথমে যেত পাঠশালায়, পরে হাই স্কুলে। পথে দুটো সাঁকো পার হতে হত। জলিল নিজে আগে পার হয়ে দেখত সব নিরাপদ আছে কি-না। তারপরে কামালকে ডাকত, এইবার তুই আয়। জালালের এ রকম আচরণের কারণ আছে। কয়েক দিন আগে, অল্প সময়ের ব্যবধানে কামালের দুটো ঘটনা হয়েছিল। কামাল ও কয়েকজন ছেলে নদীতে ডিঙি নৌকার উপরে লাফালাফি করছিল। ছোট ডিঙি এত চাপ নিতে পারে নি। গেল সেটা উল্টিয়ে। ছেলেগুলো সব পানিতে পড়ে গেল। গ্রামের ছেলেরা সাঁতারে পটু। কারোর কোন অসুবিধা হল না। কিন্তু কামাল মাথায় আঘাত পেল ডিঙির এক কোণা দিয়ে। বেচারার মাথা শো শো করে চক্কর দিয়ে উঠলো। সাঁতারের শক্তি হারিয়ে ফেলে পানিতে ডুবা আরম্ভ করলো। বিষয়টা সবার আগে জলিল দেখল।
অনেক কষ্টে জলিল ছোট ভাইকে সাঁতরে ডাঙ্গায় নিয়ে এলো। কিন্তু ততক্ষণে কামাল অচেতন হয়ে পড়েছে, পেটে পানি যেয়ে একেবারে ঢোল বানিয়ে ফেলেছে। পরে কামাল অবশ্য সুস্থ হল ঠিকই, কিন্তু আতঙ্কটা জলিলের মাথায় একেবারে চিরস্থায়ীভাবে স্থান করে নিল। তার সামনে ছোট ভাইয়ের যদি কিছু হয়ে যেত, তা হলে বাবা-মাকে সে কি বলতো। দু সপ্তাহ পরে স্কুলে যাওয়ার পথে কামাল সাঁকো থেকে অসাবধানবশত পড়ে গেল পানিতে। নিচে পানি বেশী ছিল না। তার পরেও বড় ভাই লাফ দিয়ে পানিতে নেমে যেয়ে ছোট ভাইকে উঠিয়ে নিয়ে আসলো। এর পর থেকে জলিল নিজেকে একটা অলিখিত দায়িত্ব দিল, সব সময়ে ছোট ভাইয়ের কাছাকাছি থাকতো হবে। বলা তা যায় না, কখন কোন বিপদ আসে। সে যদি সাথে সাথে না থেকে কামালকে কে রক্ষা করবে।
জলিল নিজে পড়ালেখায় না এগুলেও, ছোট ভাইয়ের পড়ালেখার ব্যাপারে উৎসাহের কোন কমতি ছিল না। কোন রকমে ধাক্কায় ধাক্কায় ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত আসতে পেরেছিল। কিন্তু কামালের মাথা ছিল বেশ ভাল। এক ক্লাস থেকে আরেক ক্লাসে একবারেই পাশ করে ফেলত। এমনকি গ্রামের ছেলে হয়ে ইংরেজিতেও বেশ পোক্ত হতে পড়েছিল। রীতিমত ইংরেজিতে কথা বলতে পারতো। স্কুলের মাস্টার মশাইরা সব সময়ে কামালকে বাহবা দিতেন। অন্যদিকে জলিল নিজের অক্ষমতায় বিন্দুমাত্র লজ্জিত ছিল না। ধরেই নিয়েছিল সে যতটুকু শিখেছে, তা দিয়ে তার জীবন বেশ চলে যাবে। গ্রামের বেশীর ভাগ মানুষ সে যতটুকু পারে, তারা সেটাও পারে না। সে কষ্ট হলেও নিজের নাম লিখতে পারে, মানুষের চিঠি পড়তে পারে, ছোট খাটো হিসেব করতে পারে।
ছোট ভাইকে নিয়ে জালালের মেলা স্বপ্ন। একবার গ্রামে একজন লম্বা, চওড়া সরকারি সাহেব এসেছিল। ব্রিটিশ অথবা পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষ। কি সুন্দর তার পোশাক-আশাক। সাথে কিছু বাঙালিও এসেছিল। এইদিক ওইদিক ঘুরে ফিরে সাহেব বেশ অনেক কথা বার্তা বলেছিল। গ্রামের মানুষজন সাহেবকে দেখার জন্যে ভিড় করে ফেরেছিল। বালক জলিলের সে রকম একজন সাহেব হওয়ার ইচ্ছা হয়েছিল। কিন্তু পরের মুহূর্তে মনে হয়েছিল, না সেইটা তো আর সম্ভব না। এ জন্যে নিশ্চয়ই মেলা জ্ঞান বুদ্ধি লাগে। তবে মাথায় আরেকটা সম্ভাবনা উকি দিল। ছোট ভাই কামাল তো অনেক চালাক চতুর। সে পারবে অনেক দূর এগুতে। তখন ছোট ভাইয়ের সাথে তার সম্মানও কত বেড়ে যাবে। সাত গ্রামের মানুষ তাদের নাম জানবে। মানুষে বলা-বলি করবে, ঐ যে জালাল, তার ছোট ভাই কামাল একেবারে সাহেব হয়ে গেছে।
গ্রামের কিছু ছেলে গিয়েছিল যশোরে বেড়াতে। এইটা সেটা কেনা ছাড়া, মূল্য আকর্ষণ ছিল ‘তসবির মহলে’ বাংলা, উর্দু সিনেমা দেখা। মাসে কমপক্ষে একবার গ্রামের উঠতি বয়সের ছেলেরা এই কাজ করতো। কিছু টাকা জমলেই যশোর চলো, যশোর চলো। এ রকম এক সফরে সেবার কামাল এসেছিল। দেখল জিলাই স্কুলের মাঠে পুলিশে মানুষ ভর্তি করানোর পরীক্ষা চলছে। অনেকটা কৌতূহলবশত রহিমপুর গ্রামের ছেলেগুলোও লাইনে দাঁড়ালো। তার দু বছর আগে সে ম্যাট্রিক পাশ করেছে। কলেজে আর ভর্তি হয়ে উঠে নি। ভাবছিল কোন কাজে উঠা যায়। সাথের দু সুযোগ পেল পুলিশ সেপাই পদে। কিন্তু ভাগ্য ভাল বলতে কামালের। স্বাস্থ্য পরীক্ষা, লিখিত পরীক্ষায় ভাল ভাবেই পাশ করলো। পুরো দলের মধ্যে কামাল-ই একমাত্র ম্যাট্রিক পাশ করা। পুলিশের বড় অফিসার বললেন কামালকে তিনি সাব ইন্সপেক্টর পদে চাকরি দিবেন। প্রথমে রাজশাহীতে এক বছর ট্রেনিং নিতে হবে, তার পরে পুরো চাকরি। বেতন আরম্ভ হবে তিন শত আঠারো টাকা দিয়ে। তার পরে প্রতি বছর কিছু কিছু বাড়বে।
এত টাকার চাকরি। বাড়ির সবাই মহা খুশী। সবচেয়ে খুশী বড় ভাই জলিল। আল্লাহ তা আলাকে সে হাজারবার ধন্যবাদ জানালো। তিনি নিশ্চয়ই তার স্বপ্নের কথা শুনেছেন। জালাল ধরেই নিল, কামাল একদিন বড় পুলিশের অফিসার হবে; অনেক টাকা আয় করবে। সে সবাইকে বলে বেড়াবে কামালের কথা। গ্রামের মানুষ তাকে ডেকে এক কাপ চা খাইয়ে ছোট ভাইয়ের গল্প জানতে চাইবে। সে এক এক করে, কামালের পানিতে ডুবে যাওয়ার কথা বলবে, সাঁকো থেকে পড়ে যাবার কথা বলবে। শেষে গ্রামের মানুষদের বলবে, দেখতে হবে না কার ছোট ভাই।
কামাল পুলিশে ট্রেনিঙে যাবার পর থেকেই, জালাল সুযোগ পেলে ছোট ভাইয়ের সাথে দেখা করে আসতো। যখন রাজশাহীতে ছিল, ১০ দিন -দু সপ্তাহ পর ভাইকে দেখে এসেছে। প্রয়োজনীয় উপদেশ দিয়ে এসেছে। বারে বারে বলে এসেছে, বিপদ-আপদ থেকে দূরে থাকতে। শেষে মনে করিয়ে দিয়েছে, সে যেহেতু আশে পাশে নাই, তার মানে হল ছোট ভাইকে সমস্যা থেকে বাঁচানোর কেউ নাই। প্রথমে কামাল বড় ভাইয়ের কর্মকাণ্ডে খুব বিরক্ত হত। ভাইকে বুঝানোর চেষ্টা করতো, সে এখন বড় হয়েছে, নিজের দেখভাল নিজেই করতে পারে। কিন্তু কে শুনে কার কথা। দু সপ্তাহ গড়াতে না গড়াতেই, জালাল হয়ত মুড়ি, পাটালি গুড় কিংবা লিচু, কাঁঠাল নিয়ে হাজির হয়েছে। এ সবই কামালের প্রিয়। পরে সে মেনে নিয়েছে। তবে ভেবে পায় নি, ভাই ভাইকে এত ভালোবাসে কি করে! কই অন্য কারোর ভাই এত বার করে আসে না।
ট্রেনিঙের পরে কুমিল্লা কোতোয়ালি থানায় কামাল কাজ আরম্ভ করলো। অল্প সময়ে বড় অফিসাররা তার উপরে ভরসা করা আরম্ভ করলো। কোন কেসের তদন্তের দায়িত্ব দিলে, খুব সুন্দর করে ঘটনা উদঘাটন করে ফেলতো। মাথা যেহেতু ছোট বেলার থেকেই ভাল, ঝামেলার অপরাধের মূলে যেতে বেশী বেগ পেতে হত না। জোড়া খুন হয়েছিল চৌ রাস্তার খাদি দোকানের পিছনে। শহরের দু জন বড় ব্যবসায়ী কে না কাড়া গুলি করে পালিয়ে যায়। হত্যাকাণ্ডের সুরাহা করার দায়িত্ব পড়লো সাব ইন্সপেক্টর কামলালের ঘাড়ে। সে সময়ে এ নিয়ে পত্র পত্রিকায় অনেক লেখালেখি হয়েছিল। এই কাজে কামাল যখন দক্ষতার সাথে সাফল্য দেখিয়ে আসামী গ্রেফতার করলো, তখন তার নাম ছড়িয়ে পড়লো। আরেকবার একদল রাজনৈতিক বিক্ষোভকারী থানা আক্রমণ করে বসেছিল। ঘটনাক্রমে সে সময়ে থানায় কামাল ছিল। অল্প কিছু সদস্য নিয়ে কামালের নেতৃত্বে পুলিশ সেদিন প্রায় হাজার দু য়েকের বিশাল জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে পেরেছিল। ফলে কুমিল্লা সদর থানা লুট হওয়ার থেকে রক্ষা পায়।
কামালের নিষ্ঠা ও কর্ম দক্ষতার খবর ঢাকা সদর দফতরে পৌছতে সময় লাগলো না। কামালকে ঢাকায় বদলি করে দেয়া হল।
নতুন কর্মস্থল হল ঢাকার রাজারবাগ। যোগদানের তারিখ পয়লা মার্চ, ১৯৭১।
৬
পুরো ঢাকা শহর জুড়ে মিছিল, হরতাল, হৈ চৈ ও উত্তেজনা। বাঙালি নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করে দিয়েছেন, “এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” তিনি জনগণকে জানিয়ে দিয়েছেন, যার যা আছে, তাই নিয়ে প্রতিরোধ করতে নেমে আসতে। প্রতিটা বাঙালির ঘর যেন একেকটা দুর্গে পরিণত হয়। পশ্চিম পাকিস্তানের মূর্খ সেনা কমান্ডাররা ভেবেছিল, অস্ত্রের ঝনঝনানি শুনলে বাঙালি ভয় পাবে, দিশেহারা হয়ে শান্ত হয়ে বাড়ি ফিরে যাবে। কিন্তু হিতে বিপরীত হল। পুরো জাতিটাই মনে হয় রাস্তায় নেমে পড়লো। নিজেদের অধিকার তার আদায় করেই ছাড়বে।
কামালকে প্রমোশন দিয়ে ঢাকায় বদলি করে আনা হয়েছিল। এখন একেবারে পুরো ইন্সপেক্টর; ইন্সপেক্টর কামাল আহমেদ। তার দায়িত্ব হওয়ার কথা ছিল ডিবি মানে ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চে। কিন্তু প্রথম দিনেই ডিআইজি সাহেব জানিয়ে দিলেন, আপাতত তদন্ত, ফদন্ত করার দরকার নাই। এখন পুলিশ বাহিনীর প্রধান কাজ হল পাবলিক ঠেকানো। ওদের সামাল দিতে না পারলে, মহ বিপদ। প্রতি দিনই প্রেসিডেণ্ট ইয়াহিয়া খানের অফিসের থেকে হুমকি, ধামকি আসছে, “বাঙালি পুলিশ সামাল দিতে না পারলে, সেনাবাহিনী রাস্তায় নামবে। একেবারে গুলি করে সাফ করে দিবে। তখন ব্যাটারা বুঝবে কয়টা ধানে কয়টা চাল।”
বাঙালি পুলিশরা সুযোগ পেলেই ফিস ফিস করে কথা বলেছে। আর যাই হোক বিক্ষোভরত বাঙালিরাও বলতে গেলে আত্মীয়। নিজের মানুষের উপর লাঠি চার্জ, টিয়ার গ্যাস ছোড়া, গুলি করতে একেবারেই মন চায় না। তার পরেও সরকারি চাকরি বলে কথা। না চাইলেও হুকুম পালন করতে হয়। তা সস্ত্বেও, হাজার হাজার বিক্ষোভকারী সামাল দেয়া কি আর চাট্টিখানি কথা। ওই দিনতো সেক্রেটারিয়েটের দেয়াল ভেঙ্গে প্রায় ঢুকেই পড়েছিল। কামালের ডিউটি ছিল সেখানেই। লাঠি চার্জ, টিয়ার গ্যাস কোনটাতেই সুবিধা করতে পারছিল না। এ রকম পরিস্থিতিতে গুলি চালানোর অর্ডার ছিল। কিন্তু ইন্সপেক্টর কামাল কাজটা করতে দ্বিধা করছিল। আবার বিক্ষোভকারীরা সেক্রেটারিয়েট পর্যন্ত পৌঁছাতে পারলে মহা বিপদ। এতগুলো সরকারি কর্মচারীর কি দশা হবে। এ রকম অবস্থায় কামালকে তৎক্ষণাৎ সিন্ধান্ত নিতে হবে, কিভাবে ওদেরকে বাঁচানো যায়।
ইন্সপেক্টর কামাল আহমেদের ভাগ্যটা কিছুটা সু প্রসন্ন বলতে হবে। জনগণের হট্টগোল দেখে সেক্রেটারিয়েটের মূল গেটের পাশে যে দু ট্রাক ইপিআর (পরবর্তীতে বিডিআর) সদস্য রিসার্ভ রাখা হয়েছিল, তারা সাহায্যে এগিয়ে আসলো। আরম্ভ হল লাঠি চার্জ ও টিয়ার গ্যাস ছোড়া। জনগণও অবিরাম ইট, পাথর ছুড়তে থাকলো। শেষ পর্যন্ত রক্ষা করা গেল সরকারি জান-মাল ও কর্মচারী। কামাল উপর ওয়ালার দরবারে অনেক শোকর আদায় করলো। ভাগ্যিস ইপিআর এগিয়ে এসেছিল, না হলে যে কি হত! নিজের জানটাও থাকতো কি-না।
ওই দিকে কামালের বড় ভাই জালাল, একেবারে অন্য এক বিষয়ে ঝুঁকে পড়েছে। গ্রামের সবাই বিষয়টা জানে। আর এই ছেলেটাকেই এক সময়ে বাছুর বলে ক্ষেপাতো। কারণ হল সে মায়ের সাথে সারাক্ষণ লেগে থাকতো, পিছনে পিছনে ঘুরতো। একেবারে গরুর বাছুরের মত। তার থেকে জালালের নাম হয়ে গিয়েছিল বাছুর। সেই বাছুরই মায়ের কাছে থাকে না বললেই চলে। অবশ্য একটা কারণ এর পিছনে আছে। বাবা যখন নদী পার হতে যেয়ে নৌকা উল্টে মারা গেলেন, তখন দু ভাই একেবারে ছোট। বাবা বাড়ি ছাড়া কোন সম্পদ রেখে যান নি। মাকে আয় রোজগারে নামতে হল। কেউ না বললেও, জালাল বুঝে নিল এখন থেকে মায়ের পিছনে পিছনে ঘুরা যাবে না। নিজেকে স্বাধীনভাবে চলতে হবে। শুধু তাই না, মা যেমন তাকে এতদিন আগলে রেখেছিলেন, তাকেও এখন থেকে ছোট ভাইকে বিপদ-আপদ থেকে দূরে রাখতে হবে।
কামাল পুলিশে চাকরিতে যোগ দেয়ার পর, জামাল রাজনীতির দিকে ঝুঁকা আরম্ভ করলো। প্রথমে সুযোগ পেলেই শুনতো রাজনৈতিক মিটিংগুলোতে কী নিয়ে কথা হচ্ছে। প্রথমে ব্যাপারটা তেমন বুঝতো না। পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষরা বাঙালিদের ঠকাচ্ছে। বড়, বড় ও ক্ষমতাপূর্ণ আসনগুলো নিজেদের দখলে রাখছে। যোগ্য বাঙালি থাকলেও, তাদেরকে পদে পদে বঞ্চিত করা হচ্ছে। তার মানে প্রিয় ছোট ভাই পুলিশে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে যত ভাল কাজই করুক না কেন, তাকে তার যোগ্যতার মূল্যায়ন করা হবে না। খুবই কষ্ট লাগল ভেবে যে এতে ছোট ভাইয়ের মনে কত না ব্যথা তৈরি হবে। জালাল আরও শুনল, পূর্ব পাকিস্তানের অর্জিত ধন সম্পদ দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের সব প্রাচুর্য গড়ে উঠছে। শুধু তাই না ওখানকার ২২ পরিবারের হাতে পুরো দেশের সকল ব্যবসা, বাণিজ্য, কল-কারখানার মালিকানা। মাত্র না কয়েকদিন আগে ব্রিটিশদের হাত থেকে এত সংগ্রাম করে, এত কষ্ট করে, এত প্রাণ দিয়ে দেশ মুক্ত করা হল। এইসব মাথায় খেললে একটা দীর্ঘশ্বাস এমনিতেই বের হয়ে আসে, “লাখো আদমি ভুখা হাঁয়, এ আজাদি ঝুটা হাঁয়।” পুরো দেশ জুড়েই একই অবস্থা। না এভাবে বেশী দিন চলতে দেয়া যায় না। দেশ স্বাধীন হল, কিন্তু জনগণ পরাধীন থেকো গেল, এইটা কেমন কথা?
দেখতে দেখতে জালাল রাজনৈতিক কর্মী হয়ে গেল। মিছিলে চিৎকার করে শ্লোগান দিয়ে অংশগ্রহন করতে লাগলো। পুলিশের টিয়ার গ্যাসের আক্রমণ হলে, উল্টো সেটা ছুঁড়ে মারা ভাল শিখলো। ইট পাটকেল মারা, গাড়িতে আগুন দেয়া ধরনের কাজে একেবারে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করা আরম্ভ করলো। ভিতরের রাগটা এমনিতেই বের হয়ে আসা আরম্ভ হল। পাকিস্তানীরা একের পর এক বাঙালিদের দুঃসহভাবে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করতে লাগল। অত্যাচার, গ্রেফতার, খুন কোনটাই বাদ রাখল না। বাঙালিরা সিদ্ধান্ত নিল এর জবাব না দিলেই না। ঠিক করা হল দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলে শাসকগুষ্ঠিকে বাঙালি রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা তুলে নিতে বাধ্য করা হবে। এইজন্যে বিভিন্ন জেলা থেকে কর্মী পাঠান হল ঢাকায়। তাদের মধ্যে একজন হল জালাল।
১৯৬৯ সালের জানুয়ারি মাসের ২০ তারিখে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের সামনে গুলি চলে। মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান আসাদ নামে একজন ছাত্র নেতা খুন হন। তখন তার সাথে ছিল বিরাট ছাত্র-জনতা। পুলিশ সেই দিন শুধু গুলি চালিয়েই ক্ষান্ত হয় নি; বলতে গেলে প্রায় গণ-প্রেফতার করে। যাকে সামনে পেয়েছে তাকেই নিয়ে গিয়েছে জেলে। জালালও গ্রেফতার হল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের পূর্ণ কোণা থেকে। পুলিশ গণ গ্রেফতার করলেও, তারা ঠিকই বুঝে ফেলত কে রাজনৈতিক কর্মী এবং কে সাধারণ জনতা। এক মাসের মাথায় পাক জান্তা আগরতলা মামলা তুলে নিল। বঙ্গবন্ধু সহ বেশীর ভাগ রাজ-বন্দীকে ছেড়ে দেয়া হল। কিন্তু ছাড়া হল না জালালকে। পুরো তিন বছরের জেল হয়ে গেল। কেস দেয়া হল সে নাকি বাসে আগুন দিয়েছিল।
কামাল বড় ভাইয়ের জেল হয়ে যাওয়ার খবর সময়মতই পেল। জালাল চিঠি দিয়ে জানিয়েছিল। সাবধান করে দিয়েছিল, “খবরদার তুই কিছু করার চেষ্টা করবি না। তোর চাকরিতে সমস্যা হবে। দু বছর দেখতে দেখতে কেটে যাবে। মাকে কিছু বলার দরকার নাই। বেচারা তা হলে কেঁদেই একশেষ হবে। মাকে না হলে বলিস হঠাৎ সুযোগ পেয়ে যাওয়াতে বিদেশ চলে গেছি। সম্ভব হলে মাকে ছুটি, ছাটাতে যেয়ে মাকে দেখে আসিস।” কামাল বড় ভাইয়ের উপদেশ শিরোধার্য হিসেবে নিয়েছিল। তবে মাকে খুব একটা দেখতে যেতে পারত না। পুলিশের চাকরি বলে কথা। সারাদেশ উত্তপ্ত, পুলিশের কত না দায়িত্ব। পুলিশ অফিসার কামাল আহমেদ এই পরিস্থিতিতে কি করে ছুটির আবেদন করে কিংবা বড় সাহেবই না কি করে তা মঞ্জুর করবেন?
জালাল জেল থেকে ভাল আচরণের জন্যে প্রায় বছর খানেক আগে মুক্তি পেয়ে গেল। অবশ্য ভাল আচরণের সাথে আরেকটা কারণ আছে। প্রতিদিনই যে পরিমাণ মানুষ ধরে ধরে জেলে ঢুকাচ্ছে, সে পরিমাণ জায়গা আসবে কোথা থেকে? পাক শাসকদের কাণ্ড দেখলে মনে হয়, পারলে পুরো বাঙালি জাতিকে জেলে পুড়ে রাখে। মুক্তি দেয়ার আগে ছোট জেলার সাহেব খুব শাসিয়ে ছিল, “রাজনীতি থেকে দূরে থাকবে। আবার ধরে নিয়ে আসলে, একেবারে দশ বছরের জেল।”
বাইরে এসে দেখে সেই আগের অবস্থা। হয়ত ঢাকা শহর আরও বেশী সংগ্রামী হয়ে উঠেছে। এর মধ্যে নির্বাচন হয়ে গেছে। বাঙালি আওয়ামী লীগ জয়লাভ করছে। কিন্তু বাঙালিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের কোন ইচ্ছা পাক শাসক গুষ্ঠির নাই। বিভিন্ন ধরণের তাল বাহানা করছে। শোনা যাচ্ছে পশ্চিম পাকিস্থান থেকে ব্যাপক সংখ্যক সেনা আনছে। সশস্ত্র সেনাবাহিনীকে কি বাঙালি জাতির উপর লেলিয়ে দিবে? কিন্তু পশ্চিমাদের হুমকি, ষড়যন্ত্রকে বঙ্গবন্ধু কোন পরোয়া করলেন না। ঢাকার রেস কোর্স ময়দানে ঘোষণা করলেন, “এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” জালালের ভাবতেই ভাল লাগল, বাঙালিদের নিজেদের একটা স্বাধীন দেশ হবে। তারা নিজেরাই দেশটাকে চালাবে, দেশটাকে গড়বে। অন্যদের গোলামি করা থেকে চির মুক্তি! ছোট ভাইয়ের ইয়া বড় একজন অফিসার হতে কোন বাঁধা থাকবে না।
জেল থেকে বের হয়েই ছোট ভাইকে খোঁজা আরম্ভ করল। এতদিনে নিশ্চয়ই অন্য কোথাও বদলি হয়ে গেছে। মন চাচ্ছিল, পুলিশদের অফিসে যেয়ে ভাইয়ের খোঁজ করতে। কিন্তু তারা যদি জালাল কি করে জানতে চায়। মাত্র জেল থেকে বের হয়েছে শুনলে ভাইয়ের চাকরির ক্ষতি করতে পারে। সে জন্যে ভাইয়ের খবর পেতে পেতে তিন দিন লেগে গেল। প্রথমে মাথায় ঢুকছিল না ভাইয়ের খবর কি করে পায়। ফার্ম গেটের মোড়ে দৈবক্রমে পাশের গ্রামের সাদেকের সাথে দেখা। সেই জানালো তার সাথে সপ্তাহ দুয়েক আগে কামালের দেখা হয়েছিল। সে ঢাকার রাজারবাগে থাকে। কুমিল্লা থেকে প্রমোশন পেয়ে এখানে এসেছে। এখন সে পুরো ইন্সপেকটর। জালালের গর্বে বুক ফুলে ইয়া বড় হয়ে গেল। ভাইটা ঠিকই বড় একজন হর্তা কর্তা হওয়ার পথে এগিয়ে চলেছে।
জালাল ছুটলো ভাইয়ের সাথে দেখা করতে। রাজারবাগে যেয়ে শুনল, ভাই তার এখন ভীষণ ব্যস্ত। সকালে ব্যারাক থেকে বের হয়ে যায়। ফিরতে ফিরতে সেই রাত। বড় ভাই ব্যাপারটা বুঝল। বাঙালিরা রাজপথে যতই আন্দোলন করুক না কেন, ভাই তার সরকারি কাজ করে। দেশের সম্পদ রক্ষা করার তার দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। সে ঠায় বসে থাকলো। ভাই আসবে, দেখা হবে। তার পরে সে মালিবাগে ফিরে যাবে। সেখানে এক মেসে থাকছে। এক রাজনৈতিক কর্মী তার থাকা, খাওয়া ও কিছু হাত খরচের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। ভদ্রলোকের সাথে বড় বড় নেতাদের যোগাযোগ আছে। জালালকে উনি জানিয়েছেন নেতারা তাকে এখন ঢাকায় থাকতে বলেছে। কারণ কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। তখন প্রচুর নিবেদিত প্রাণ কর্মীর প্রয়োজন হতে পারে।
তারিখটা ছিল ২৩ শে মার্চ। প্রায় মাঝরাতের কাছাকাছি সময়ে কামাল ফিরল। কপালে ব্যান্ডেজ। সেটা দেখেই জালাল অস্থির হয়ে গেল। নিজে যে এতদিন পরে জেল থেকে বের হয়েছে সেটা ভুলে গিয়ে, ভাইয়ের কত কষ্ট হয়েছে তা ভেবে অস্থির হয়ে গেল। কামাল বড় ভাইকে শান্ত করার চেষ্টা করলো, “না এ কিছু না। মিছিল থেকে কেউ ঢিল ছুঁড়ে মেরেছে। পুলিশের চাকরিতে এরকম অনেক হয়।” সাথে সাথে বিষাদে জালালের মনটা ভরে গেল। ভাইকে পুলিশে ঢুকতে না দিলে কি-ই বা হত। কি দুঃখ, সে এখন পাশে থেকে ছোট ভাইকে বিপদ থেকে সরিয়ে রাখতে পারে না।
কামালই ভাইকে বলল, সে জন্যে ব্যারাকে আপাতত দেখা করতে না আসে। চারিদিকে পাকিস্তানী চরেরা চোখ রাখছে। যদি জেনে ফেলে ভাই রাজনৈতিক কর্মী ও জেল থেকে মাত্র ছাড়া পেয়েছে, তা হলে বিরাট সমস্যা হয়ে যেতে পারে। তার পরেও দু জনে বসে মেলা কথা বার্তা বলল। মাকে নিয়ে অনেক কথা হল। বেশ কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে মন খারাপ করে বসে রইলো। দু জন জোয়ান ছেলে থেকেও, কেউ তার পাশে নাই। গত দু বছরে কামাল মাত্র একবার মায়ের সাথে দেখা করতে যেতে পেরেছে। অবশ্য এক মাস, দু মাস পর পর মায়ের জন্যে কিছু টাকা মানি অর্ডার করে পাঠাচ্ছে। দু জনে ঠিক করলো, পরিস্থিতি শান্ত হলেই দু জনে একসাথে যেয়ে মাকে অবাক করে দিবে।৮
একদিন পরেই ২৫শে মার্চ। দিনটা শুরু হল অন্য দিনগুলোর মত। চারিদিকে শুধু আতঙ্ক ও আতঙ্ক। বঙ্গবন্ধু ও ভুট্টো ‘র মিটিং ভেঙ্গে গেছে। এখন কি হবে? সামরিক শাসকরা আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জিতলেও ক্ষমতা বাঙালিদের কাছে দিবে না। বিবিসি বলছে পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক শক্তি বাড়ানো হচ্ছে। তা হলে জনগণের দাবী অন্যদিকে নেয়ার জন্যে নতুন করে ভারতের সাথে যুদ্ধ আরম্ভ করা হবে। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের লেশ এখনও কাটে নি। তার পরে আবার নতুন করে যুদ্ধ। তবে আবার নতুন করে যুদ্ধ চালু হলে, বাঙালি হয়ত পাক বাহিনীকে সমর্থন দিবে না। পাক সেনাবাহিনীতে যে সব বাঙালি আছে, তারাও আগের মত চরম সাহসিকতার সাথে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে কি-না সন্দেহ। তোমরা আমাদের অধিকার মানবে না, আর আমাদের দিয়ে যুদ্ধ করাবে,সেটা হতে পারে না।
চারিদিকে গুজব সামরিক শাসন আরও কঠিনভাবে আরোপ করা হবে। পাক বাহিনী বহুবার প্রমাণ আছে তারা কারণে-অকারণে বাঙালির উপরে গুলি চালাতে দ্বিধা করে না। যদি আবার একই কাজ করে তা হলে বাঙালি কিভাবে রুখে দাঁড়াবে? বেহায়া বিবেকহীন সশস্ত্র সেনাবাহিনীর সামনে জনতা একেবারে অসহায়। এইদিকে বঙ্গবন্ধু ৭ ই মার্চ ঘোষণা দিয়ে দিয়েছেন, যার কাছে যা আছে, তাই নিয়ে প্রতিরক্ষায় এগিয়ে আসতে। এই চিন্তার বুঝি কোন শেষ নাই, কী হবে কী হবে। বাঙালি জাতির কী হবে? গুলি করে কি একটা জাতিকে পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলা সম্ভব?
২৫ শে মার্চ ১৯৭১। জালালের অস্থিরতা চূড়ান্ত। কাল সারাদিন রাস্তায় রাস্তায় মিছিল, শ্লোগান নিয়ে ব্যস্ত ছিল। খাওয়া দাওয়া সারাদিন হয় নি বললেই চলে। নেতা-কর্মীদের একই কথা। কী হবে, দেশ কোন দিকে গড়াচ্ছে। অবশ্য, নিচু গলায় বলাবলি হচ্ছে, “এ বার দেশটাকে স্বাধীন করে ফেলব, ইনশা আল্লাহ।” কিন্তু বললেই কিংবা চাইলেই তো হল না। হয় পশ্চিম পাকিস্তানীরা স্বেচ্ছায় পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে চলে যাবে না; একমাত্র উপায় ওদেরকে দেশ ছেড়ে চলে যাতে বাধ্য করতে হবে। কিন্তু কিভাবে বাধ্য করা সম্ভব? যুদ্ধ করে জিততে হবে। ওদেরকে কাছে সব আধুনিক অস্ত্র, সস্ত্র। অন্যদিকে বাঙালিদের তেমন কিছুই নাই। আছে শুধু মনের জোর।
জালাল ভাবনার কোন কুল কিনারা পেল না। একই চিন্তা বাড়ে বাড়ে মাথার মধ্যে ঘুরতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যে আরম্ভ হল প্রচণ্ড মাথা ব্যাথা। একটু পরে মনে হল মাথাটা বন বন করে ঘুরছে। বুঝতে পারল গায়ে তার এখন আকাশ-পাতাল জ্বর। কি মুশকিল এ রকম সময়ে শরীর খারাপ হলে কি চলে? সামনে কত কাজ। দেশ স্বাধীন করতে হবে। এইভাবে কারো পায়ের তলায় পড়ে থাকার কোন মানে হয় না। ছোট বেলায় তার এক ধরণের মাথা ব্যথা আসতো। মা নাম দিয়েছিলেন পোড়া কপালী ব্যথা। মনে হত কষ্টে বুঝি মাথার সামনের দিকটা খুলে পড়ে যাবে। সে সময়ে জালাল ঘরের ভিতর এক কোণায় চোখ ঠেসে বন্ধ করে শুয়ে থাকত।
ব্যথাটার অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য ছিল। সকালে নাস্তার পর আসতো। দুপুরে থেকে বিকাল পর্যন্ত মাত্রা থাকতো চূড়ান্ত। তার পর কমতে কমতে মেলা রাত। ব্যথা চলে গেলে মাথাটা একেবারে হালকা হয়ে যেত। ব্যথা চলাকালীন সারাদিন জলিলের কোন আলো, শব্দ সহ্য হত না। দুটোতেই যন্ত্রণা আরও বেড়ে যেত। বছরে দু চার বার আসতো। ডাক্তার, কবিরাজি করে বিশেষ কোন লাভ হয় নি। কিন্তু সবচেয়ে আতঙ্কের কারণ ছিল অন্য। আরেকটা বিষয়। এই ব্যাথা উঠার পরের দিন বড় ধরনের কোন দুঃসংবাদ আসতো। নানা, বাবা’র মৃত্যুর আগের দিন পুরোটা সময় মাথা নিয়ে পড়েছিল। গ্রামের হাটে আগুন লেগে যে বার পাঁচ জন মানুষ পুড়ে মারা গেল, সেবারও একই ঘটনা। এইজন্য জলিলের এই ব্যাথা উঠলে সাবই আতঙ্কিত হয়ে যায় । সবার জানা ছিল দিন শেষে ওর মাথা ব্যথা সেরে যাবে। কিন্তু পরের দিন আবার কী না ঘটে। মা মনের দুঃখে এর নাম দিয়েছিলেন, পোড়া কপালী ব্যথা।
এখন মা কাছাকাছি নাই। মেসের অন্যরাও যে যার কাজে বের হয়ে পড়েছে। জলিল নিশ্চিত তার পোড়া কপালী ব্যথাটা আসছে। শরীরের কষ্ট থেকে আতঙ্কে ভুগতে লাগলো, পরের দিন আবার বড় কোন দুর্ঘটনা না ঘটে যায়। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে অস্থিরতা শতগুণ বেড়ে গেল। মনে হচ্ছিল, এবারের কষ্টটা অন্য আগের সব কষ্টকে ছাড়িয়ে গেছে। একবার সে আল্লাহ তা আলার কাছে ফরিয়াদ করলো, কাল যেন খারাপ কিছু না হয়। প্রয়োজনে তার জান চলে গেলেও ক্ষতি নাই। ছোট ভাইটার যাতে কোন সমস্যা না হয়, দেশের জনগণের যাতে কোন ক্ষতি না হয়।
বিকালের দিকে রুমমেট ফরিদ এসে একেবারে অবাক। জালাল সম্ভবত খাট থেকে গড়িয়ে নিচে মেঝেতে এসে পড়েছে। একেবারে অচেনতন। মুখ থেকে লালা বের হয়েছে। ফরিদ ছুটে আশে পাশে যারা ছিল তাদের ডেকে নিয়ে আসলো। মাথায় পানি ঢালার পর হুশ ফিরে এলো। সবাই ধরাধরি করে জলিলকে বিছানায় নিয়ে শোয়ালো। হুশ আসার পর জলিলের মাথা ব্যথার বিষয়টা মনে এলো। মাথাটা এর মধ্যে হালকা হওয়া আরম্ভ করেছে। ধাই করে মাথার মধ্যে খেলতে লাগলো, কালকে না আবার কী হয়। ভাবতে ভাবতেই নিজের অজান্তে ঘুমিয়ে পড়লো।
প্রচণ্ড একটা শব্দ হল। মনে হল কাছাকাছি কোন ইলেকট্রিক ট্রান্সফর্মার ফাটলো। জালালের মনে হল সে কোন দুঃস্বপ্ন দেখছে। পরের মুহূর্তেই বুঝতে পারলো, ঘটনা বাস্তবেই ঘটেছে। অবশ্য এর কারণ অন্য। চোখ খুলে দেখল দরজার বাইরে একটা লাইট জ্বলছে। মিনিট খানেকের মধ্যেই আরম্ভ হল, ঠা ঠা ঠা .........গুলির শব্দ। ফরিদ উঠে জালালের বিছানার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। দেখতে দেখতে মেসের সবাই সেখানে এসে জড় হল। সবার চোখে আতঙ্ক, ভয়ে মুখ শুকিয়ে গেছে, বুকটা দুরু দুরু করছে। কয়েকজন কান্নাও জুড়ে দিল।
গোলাগুলির শব্দ মিনিট দুয়েকের জন্যে একটু কমলো। চারিদিকের আর্ত চিৎকার ভেসে আসতে লাগলো। “আল্লাহ গো বাঁচাও। বাবারে, মারে ...কেউ একটু পানি দাও”। মনে হল পুরো ঢাকা শহর একসাথে আর্তনাদ করে সাহায্য চাইছে। কিন্তু না, আবার নতুন করে আরও জোড়ে গুলির শব্দ আসতে লাগলো। সাথে সাথে গ্রেনেডের প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ। মানুষের কান্না ঢাকা পড়ে গেল গুলি ও গ্রেনেডের শব্দে। বিরতিহীনভাবে কাপুরুষ পাক হানাদার বাহিনী ঘুমন্ত নিরস্ত্র বাঙালির উপরে গুলি চালিয়ে যেতে থাকলো। ভোর রাতের দিকে শব্দ কমতে কমতে বন্ধ হয়ে গেল। তার মানে পাক দস্যুরা তাদের কাজ শেষ করেছে।
নিশ্চয়ই বিধাতার অশেষ কৃপা। জালাল ও তার রুমমেটরা গোলা, গুলির শব্দ একেবারে কাছের থেকে শুনেছে। কিন্তু মেসে পাক বাহিনী আসে নি, কিংবা কোন গুলি এসেও ঢুকে নি। মেসের সবাই ফিসফিস করে দোয়া-দরুদ পড়ছিল। জালাল দুর্বল শরীরে একই কাজ আরম্ভ করল। কিন্তু তার মনের বড় আশঙ্কা কাজ করছিল, ছোট ভাই কামাল ঠিক আছে। সে আল্লাহ তা আলার কাছে ফরিয়াদ করলো, “ইয়া আল্লাহ, আমার বিনিময়ে আমার ভাইকে রক্ষা করে দাও।” একবার তো জালাল ঘর থেকে বের হয়ে যেতে নিয়েছিল। অন্যরা এসে তাকে আটকিয়ে দিল, “করেন কি? করেন কি? বাইরে গেলেই গুলি খেয়ে মরতে হবে।” জালাল সব সময়ে ছোট ভাইকে আগলে রেখেছে। এখন কি-না এই বিপদের সময়ে সে নিজেই লুকিয়ে আছে। ছোট ভাইটা যে কেমন আছে, আল্লাহ’ ই জানে।
২৫ শে মার্চ রাতে কত বাঙালি যে মরল তার সঠিক হিসেব পাওয়া এখন খুব কঠিন। পাক বাহিনী পুরো ঢাকা শহরকে একটা লাশের শহর বানিয়ে দিল। চারিদিকে শুধু লাশ আর লাশ।
৯
ধীরে ধীরে দিনের আলো ফুটলো। ১৯৭১ সালের ২৬ শে মার্চ সকাল। রুমের সবাই জানালা দিয়ে উকি দিয়ে বাইরে দেখার চেষ্টা করলো। না তেমন কিছু চোখে পড়লো না। জালাল কয়েক বার দরজা খুলে বাইরে বের হতে চেয়েছিল। কিন্তু অন্যরা টেনে ধরে রেখেছে। সকাল হওয়ার সাথে সাথে জালালকে কোনভাবেই আটকে রাখা হল না। তার একই কথা, ছোট ভাইটার কোন বিপদ-আপদ হয়েছে কি-না সেটা দেখতে হবে। কে জানে তার যদি আবার বড় ভাইয়ের কোন প্রয়োজন না হয়ে পড়ে। সাথে সাথে খারাপ আশঙ্কাটাও যে মাথার মধ্যে খেলে যাচ্ছে না, তা কিন্তু না। মনে মনে দোয়া পড়ে চললো, ভাইটার যাতে কোন ক্ষতি না হয়ে থাকে।
জলিল দরজা খুলে বাইরে আসলো। ছোট ছোট পায়ে বড় রাস্তার দিকে এগুতে লাগলো। ফরিদ কয়েকবার নিষেধ করেছিল, “তোমার এই শরীরে কোথাও যাওয়াটা ঠিক হবে না। তা ছাড়া বলা তা যায় না আবার কখন সেনারা গুলি আরম্ভ করে।” অবশ্য ফরিদের জানা ছিল জালালকে এখন কেউ আটকাতে পারবে না। অল্প কয়েকদিনের জন্যে মানুষটার সাথে অন্তরঙ্গতা তৈরি হয়ে গেছে। দেশ ও ভাই ছাড়া মনে হয় আর কিছু বুঝে না। এর মধ্যে আপনি থেকে তুমি এবং বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। সম বয়সী মানুষটার একা ছেড়ে দিতে ইচ্ছা করলো না।
রাস্তার মোড় থেকেই পাক হানাদারদের নৃশংসতার পরিচয় পাওয়া আরম্ভ করলো। সিদ্দিক মুনসীর মুদির দোকানের পাশে তার লাশ পড়ে আছে। বেচারা দোকানের ভিতরেই রাতে থাকতো। পান, বিড়ি, সিগারেট, কলা, চা জাতীয় জিনিসপত্র বিক্রি করতো। সম্ভবত আওয়াজ শুনে দোকান খুলে বের হয়ে এসেছিল। মুনসীর মুখটা ওদের পথপানে করা ছিল। বুকে গুলি করে ঝাঁঝরা করে দিয়েছে। চোখ দুটো খোলা। মনে হয় এক নয়নে জালাল, ফরিদের অপেক্ষায় ছিল। শক্ত, পাথর চোখ ওদেরকে কিছু বলছে।
দু জনে যেদিকে তাকাচ্ছে সেখানেই শুধু লাশ আর লাশ। পাক হানাদাররা এইটা কি করলো। ওদের বিবেক বলে কি কিছু নাই? নিষ্পাপ মানুষগুলোর উপরে গুলি চালাতে কি একবারও হাত কাঁপে নি? রাস্তার মোড় ছাড়িয়ে গেলে যে বাজার এবং তার পিছনে যে বস্তি, দুটোকেই পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে। কেমন যেন একটা গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। হয়ত জীবন্ত মানুষ পুড়লে এ রকম গন্ধ হয়। পাড়ার কুকুরগুলো পোড়া মানুষের মাংসের সন্ধান পেয়ে গেছে। পোড়া ছাই সরিয়ে মাংস খাচ্ছে। এই দৃশ্য না দেখলে বিশ্বাস করা যাই। ঘুমন্ত বাঙালিদের এইভাবে আগুনে পুড়িয়ে মারলো। এখন কি-না কুকুরগুলো মানুষের মাংস খাচ্ছে। কী লজ্জা, কী অপমান।
দু জনে পায়ে হেঁটে এগুতে থাকলো। রাস্তায় গাড়ি, রিকশা, বাস কিছুই নাই। মাঝে মাঝে পাক হানাদারদের ট্রাক সাই করে চলে যাচ্ছে। এত লাশ যে পড়ে আছে সে দিকে কোন ভ্রুক্ষেপ করছে না। নিজেরা নিজেরা কথা বলছে, হাসাহাসি করছে গত যেন কাল রাতে কিছু হয় নি। জালাল, ফরিদের মত আরও কিছু বাঙালি ভীতভাবে এইদিক ওইদিক তাকাচ্ছে। আবার না পাক হানাদাররা তাদের উপরে গুলি চালিয়ে ফেলে! না সে রকম কিছু হল না। পাক বাহিনী ওদের দেখেও কোন প্রতিক্রিয়া করলো না। সারা শহর যে পরিমাণ লাশের স্তূপ সেগুলো সরাতেও মানুষ লাগবে। পাক সেনারা তো একেক জন বড় সাহেব। হয়ত এই জন্যেই কিছু বাঙালি ইচ্ছা করেই মারে নি। জীবিতরা জাত ভাইবোনদের সৎকার করতে না পারলেও, নিদেনপক্ষে লাশগুলো মাটি চাপা দিবে। নেমকহারাম হানাদাররা যাদের উপার্জিত অর্থ আত্মসাৎ করে নিজেদের চাকচিক্য বাড়িয়েছে, তারেদই কি-না রাতের গভীরে এর নৃশংসভাবে খুন করলো। এরা কি মানুষ? পাক হানাদাররা এত পাষাণ সীমার হল কি করে?
রাজারবাগ পর্যন্ত আর ওদের যেতে হল না। পুরো পুলিশ লাইন সেনারা ঘিরে রেখেছে। বুঝলো তাণ্ডবলীলার মাত্রা এখানে আরও বেশী। হঠাৎ একটা সেনা ট্রাক এসে তাদের পাশে এসে দাঁড়ালো। বন্দুক দেখিয়ে দু জনকে ট্রাকে উঠালো। ট্রাকের ভিতরে আরও কয়েকজন বাঙালির দেখে মিলল। ট্রাক পুলিশ ব্যারাকের সামনে এসে দাঁড়ালো। এখন আর ব্যারাক চেনা যাচ্ছে না। মাত্র দু দিন আগেই না জালাল এখান থেকে ঘুরে গেছে। ব্যারাকের সব পুলিশ ওরা মেরে ফেলেছে। সরকারি চাকরি করার এ কি পুরস্কার তারা দিলো?
জালাল, রফিকদের সাথে আরও পাঁচ জন বাঙালি তারা জোগার করেছিল। বন্দুক উঁচিয়ে হুকুম দিল, যাও লাশগুলো নিয়ে ট্রাকে তুলো। ইচ্ছা না থাকলেও, কাজটা তাদের আরম্ভ করতে হল। দু জন করে একটা করে লাশ নিয়ে আসা আরম্ভ করলো। ট্রাক ভরে যেতে বেশী সময় লাগল না। শেষের দিকে জালাল ও ফরিদ যেয়ে যেই লাশটা ধরল, ফরিদ না চিনলেও জালাল নিজের ছোট ভাইকে ঠিকই চিনলো। মুখের বেশীর ভাগ পুড়ে গেছে। পেটে গুলি লেগে বড় গর্ত হয়ে গেছে। সারা শরীর রক্তে ভেসে গিয়েছিল। এখন রক্ত শুকিয়ে শক্ত হয়ে গাঢ় একটা রং ধারণ করেছে। এ যে কামালের লাশ। বড় ভাই একবার ডুকরে কেঁদে উঠলো। ফরিদ সাথে সাথে বিষয়টা বুঝে ফেললো। ফিসফিস করে বললো, “এই লাশ যে আমার চিনতে পেরেছে, এইটা হানাদাররা জানতে পারলেই বিপদ। আমাদেরও মেরে ফেলবে।” শরীরের সমস্থ ঘৃণা, রাগ জায়গায় করে চিবিয়ে চিবিয়ে উচ্চারণ করলো, “আমাদের মরলে চলবে না। প্রতিশোধ। আমাদের প্রতিশোধ নিতে হবে। না হলে আল্লাহ আমাদের মাফ করবে না। ”
বাঙালিদের ধৈর্য পরীক্ষা দেয়া আরও বাকী ছিল। জীবিত বাঙালিদের দিয়ে মৃত বাঙালিদের লাশ ট্রাকে উঠিয়ে নিয়ে গেল রায়ের বাজার ছাড়িয়ে এক ইটের ভাটার পিছনে। সেখানে আরও কয়েকটা পাকিস্তানীদের ট্রাক দাঁড়িয়েছিল। ওইসব ট্রাকের সাথে যে সব বাঙালি ধরে নিয়েছিল, তাদেরকে দিয়ে মাটির গর্ত খুঁড়াচ্ছে। জালাল, ফরিদ ও সাথের বাঙালিদের একই কাজে লাগিয়ে দিল। দেখতে দেখতে বিশাল বড় গর্ত হয়ে গেল। তার পরে নতুন হুকুম দিল, ট্রাক থেকে লাশ নামিয়ে গর্তের মধ্যে ফেলতে। কয়েকজন বাঙালি হানাদারদের হুকুম অমান্য করাতে গুলি খেয়ে জীবন দিল।
জানোয়াররা শেষে যেই কাজটা করলো, সেটা জলিল আগেই বুঝে ফেলেছিল। সুযোগমত ফিসফিস করে ফরিদকে কিছুটা একটা বলল। এক পাক সেনা দেখে ফেলল ওরা কথা বলছে। সাথে সাথেই বিশ্রী ধরণের একটা গালি শুনলো, “বানচোত মালোয়ান কাম কারো, স্রেফ বাত কারতা হায়। নেইতো গুল্লি কারকে জাহান্নামমে ভেজ দেয় গা।” অপমান সহ্য করেও ঠোঁট চেপে কাজ চালিয়ে গেল। বিশাল বড় গর্তটার মধ্যে সবগুলো লাশ ফেলা হল। তারপরে যে সব বাঙালি এতক্ষণ সেনাদের কাজ করতে বাধ্য হয়েছিল, তাদের লাইন করে দাঁড় করালো। এক হানাদার সাথে সাথে স্টেন গান দিয়ে ব্রাশ ফায়ার করলো, বাম থেকে ডান।
গুলির সাথে সাথে এক জন, এক জন করে আর্তচিৎকার দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়তে থাকলো। মিনিট দুয়েকের মধ্যে গোটা ত্রিশেকের মত বাঙালি মাটির মধ্যে লুটিয়ে পড়লো। পাক হানাদাররা পায়ের বুট দিয়ে লাঠি মেরে মেরে নতুন লাশগুলোকে গর্তের মধ্যে ফেলল। শ্রমের মূল্য এইভাবেই বদমায়েশরা মেটালো। হায়রে তোরা পশুর থেকে অধম, নরকের কীট থেকেও অধম!
সেনারা ট্রাকে উঠে বিজয়ের হাসি হাসতে হাসতে বালি উড়িয়ে চলে গেল। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে শরীরের বালি ঝাড়তে ঝাড়তে উঠে দাঁড়ালো এক বাঙালি ফরিদ। নিচু কণ্ঠে ডাকতে লাগলো, জালাল, জালাল ও জালাল। একটা গোঙ্গানি ধরণের শব্দ এলো। জালাল বেশ কিছু লাশের নিচে চাপা পড়ে আছে। ফরিদ যেয়ে তাকে টেনে তুললো। দু জন আসলে আগের থেকেই প্ল্যান করে রেখেছিল, গুলি লাগার আগেই তারা মাটিতে পড়ে যাবে। উল্টিয়ে পড়ে এমন ভান করবে, যাতে পাক্কুরা তাদের মৃত্যু হয়েছে বলে ধরে নেয়।
দু বাঙালির অভিনয় ভালই কাজ করলো। এতগুলোর বাঙালির মধ্যে শুধু এই দু জন প্রাণে রক্ষা পেল। তবে প্রাণে রক্ষা পেলেও, মুখে উচ্চারণ না করলেও, তাদের শরীর, মন থেকে আগুন কঠিন শপথ বের হয়ে এলো, “এ জানোয়ারদের শেষ করতেই হবে। এই অত্যাচারের দাঁত ভাঙ্গা জবাব দিতেই হবে। বাঙালিদের এই পরাধীনতা থেকে মুক্ত করতেই হবে। যেই প্রাণ তারা আজকে অভিনয় করে বাঁচিয়েছে, সেই প্রাণ এই পাক হানাদারদের নিশ্চিহ্ন করতে দিয়ে দিতে এক ফোটাও দ্বিধা করবে না।”
১০
প্রতিশোধ নিতে হলে অস্ত্র দরকার, প্রশিক্ষণ দরকার। পুরো ঢাকা শহর সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত। মানুষ জন তেমন ঘর থেকে বের হচ্ছে না। সেনাবাহিনী ভারী অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ব্যাটারা নিজেরাই নিরীহ ঘুমন্ত বাঙালিদের মেরে নিঃশেষ করার চেষ্টা করলো। এখন অপেক্ষা করছে, কেই না উল্টো আক্রমণ করে বসে। পাপ করলে শাস্তি তো পেতেই হবে। সাপের লেজে যখন কাটতে চেয়েছে, ছোবল খাওয়া তো শুধু সময়ের ব্যাপার। জালাল পরিচিত মানুষদের সাথে যোগাযোগের কোন উপায় খুঁজে পেল না। তবে মনে হল, কোন এক রাজনৈতিক সভায় শুনেছিল, প্রয়োজনে তাদের সীমান্ত অতিক্রম করে ভারত যেতে হবে। প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র চেয়ে সাহায্য চাইলে, তারা না করতে পারবে না।
সীমান্ত অঞ্চলে বাড়ি হলেও, জালাল কখনও ভারতে যায় নি। ফরিদের অবস্থা অনেকটা একই রকম। বাড়ি তার বুড়ি গঙ্গার ওই পারে, আহালিয়া গ্রামে। বহুদিন ধরে ঢাকায়। ভারত কি চট্টগ্রাম, সিলেট পর্যন্ত যাওয়া হয় নি। শুধু একবার কুমিল্লা গিয়েছিল। তাও আবার একবন্ধু অনেকটা ধরে বেঁধে বোনের বিয়েতে নিয়ে গিয়েছিল। চাকরির পরে যতটুকু ফ্রি টাইম পায়, পুরোটাই পারলে ঘুমিয়ে পার করে দেয়। এ রকম দু জন যুবক পায়ে হেঁটে রওয়ানা দিল ভারতের উদ্দেশ্যে। যত কষ্টই হোক, গন্তব্যে তাদের পৌঁছে প্রশিক্ষণ নিয়ে ফিরতে হবে। দেশ থেকে এই জানোয়ারদের তাড়াতে হবে।
জালাল ভাল করেই জানতো তাদের গ্রামের বাড়ি রহিমপুর থেকে ভারতের সীমান্ত একেবারে কাছে। ঠিক করলো, দু জনে এক সাথে প্রথম রহিমপুর যাবে। মায়ের সাথে বহুদিন দেখা হয় না। তা ছাড়া ছোট ভাইয়ের মৃত্যুর খবরটাও মাকে দেয়া দরকার। তার পরে ভারত। দু জনে মেসে যেয়ে হাতের কাছে যা পেল তাই গুছিয়ে নিল। সাথে তেমন টাকা পয়সা ছিল না। যা আছে তাই সম্বল করে রাস্তায় নেমে পড়লো। সে এক বড় বিচিত্র ধরণের যাত্রা আরম্ভ হল। রিকশা, বাস, নৌকা --যখন যেটা পেল, সেটা করেই এগুতে থাকলো। তবে পায়ে হেঁটেই সব চেয়ে বেশী চলতে হল। পাক সেনাদের এড়িয়ে মেলা ঘুরা পথে চলতে থাকলো। মাঝে কত দিন-রাত এলো ও গেলও, তার হিসেব এক পর্যায়ে হারিয়ে ফেলল।
হানাদার বাহিনী শুধু ঢাকা শহর আক্রমণ করেই ক্ষান্ত হয় নি। মফস্বল, গ্রামগঞ্জ পর্যন্ত তাদের থাবা বিস্তার করতে থাকল। যেখানেই পাক্কুরা যাচ্ছে মানুষ মেরে আর দোকান পাট পুড়িয়ে সব ছারখার করে ফেলছে। জালাল, ফরিদের মত প্রচুর মানুষ দলে দলে ভিটে মাটি ছেড়ে পালাচ্ছে। আগে তো জান বাঁচাতে হবে। লোকে বলাবলি করছিল, জায়গায় জায়গায় হানাদাররা ক্যাম্প করেছে। এর মধ্যে অর্থ, ক্ষমতার লোভ দেখিয়ে নিজেরদের দলে কিছু বাঙালিকে ভিড়িয়ে ফেলেছে, নাম দিয়েছে ‘শান্তি কমিটি’। জামাতি, মুসলিম লীগের সদস্যরা স্বজাতির সাথে বেইমানী করে হানাদারদের পক্ষ নিয়েছে।
রহিমপুরের দু গ্রাম পূর্বে সিদ্দিকপুর। ওই গ্রাম দিয়ে যাওয়া সময় জালাল, ফরিদ দু জনে খুব বিস্মিত হল। গ্রামে কিছু মহিলা, পুরুষ ছাড়া কেউ নাই। দু জনে ঝোপ ঝাড়ের ভিতর দিয়ে এগুচ্ছিল। তারপরেও কৌতূহল ধরে রাখতে পারলো না। এক বৃদ্ধাকে পেয়ে ফরিদ জানতে চাইল বিষয়টা কি? উনি জানালেন, মিলিটারি এসে যত পুরুষ সামনে পেয়েছে, তাদের লাইন করে দাঁড় করিয়ে গুলি করে মেরেছে। তার পর থেকে গ্রামে চাষাবাদ, কাজ কর্ম সব বন্ধ। বাকী পুরুষরা সব পালিয়ে গেছে। বেশীর ভাগই ভারতে পালিয়েছে। আর যাদের ছোট বাচ্চা কাচ্চা আছে, তার এই দিক সে দিক লুকিয়ে থাকে। সুযোগ পেলেই পরিবারের সাথে দেখা করে যায়। তাদের মাথায় ঢুকছে না, তারা কি করতে পারে কিংবা এর শেষই বা কোথায়।
দেখতে দেখতে দু জনের দলটা বড় হয়ে বারো জন হয়ে গেল। অন্যরাও একই উদ্দেশ্য নিয়ে বের হয়েছিল। পথে ঘটনাক্রমে দেখা। এখন তারা একে অপরের কাছের মানুষ। জালাল সবার বড় ভাই হয়ে গেল। বয়সে অন্যদের কিছু বড় হলেও, তারই একমাত্র ধারণা আছে কিভাবে ভারতে যাওয়া যেতে পারে। সিদ্দিকপুর যখন পার হচ্ছে, তখন মেলা রাত। পা টিপে টিপে হেঁটে তারা এগিয়ে চলেছে। হঠাত রাতের নিস্তব্দতা ভেঙ্গে কান্নার শব্দ শুনতে পেল। একজন পুরুষ মানুষ মনে হয় নিজের কান্না সামাল দেয়ার চেষ্টা করছে। সাথে ছোট একটা শিশু কেঁদেই চলেছে।
কান্নার উৎস সহজেই খুঁজে পাওয়া গেল। যুবকের বয়স হয়ত বছর পচিশেক হতে পারে। জানা গেল, বাচ্চার মাকে পাক সেনারা ধরে নিয়ে গেছে। সে বাসায় ছিল না বলে রক্ষা পেয়েছে। বাড়িতে এখন এমন কেই নেই যে বাচ্চাটাকে দেখে শুনে রাখবে। মিলিটারি ক্যাম্পে যেয়ে যে বউটাকে ফেরত চাইবে, সেই উপায়ও নাই। ওখানে গেলে গুলি করেই মেরে ফেলবে। মাকে ধরে নিয়ে গেছে এই অজুহাত দেখিয়ে অন্য কোন মহিলা বাচ্চাটাকে রাখতে রাজী হয় নি। পাছে তাদেরও বিপদ হয়। বাবা হয়ে বুঝতে পারছে না, ছোট শিশু সন্তানকে নিয়ে কী করবে। শত চেষ্টা করেও বাচ্চাটার কান্না থামাতে না পেরে, নিজেই চরম হতাশায় কান্না আরম্ভ হয়েছে। এইভাবে সে তার ফরিয়াদ আল্লাহ তা আল্লাহ’র দরবারে পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করছে। আল্লাহ যদি একবার মুখ তুলে তাকায়। তার দুঃসময়ের যাতে শেষ হয়।
যুবকের নাম সাদেক। জালাল জানাল, কিছু দূরে তাদের গ্রাম। তার মা আদর যত্নে তার শিশুকে রাখবেন। পরে সাদেক যখন চাইবে, বাচ্চাকে নিয়ে আসতে পারবে। সাদেক তার বাচ্চাকে নিয়ে দলটার সাথে চলা আরম্ভ করলো। হাঁটতে হাঁটতে জানলো সবার-ই এমন করুণ সব কাহিনী আছে। সাদেকও সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিল, দলটার সাথে সেও ভারতে যাবে। পাক হানাদারদের বিষ দাঁত সে উপড়ে ফেলতে চায়।
রহিমপুরে দলটা শেষ রাতে যেয়ে পৌঁছালো। জালাল অন্যদের বললো, তারা যেন ঝোপের মধ্যে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে। এতগুলো মানুষ এক সাথে দেখলে গ্রামবাসী ভয় পেয়ে ডাকাত ভেবে হৈ চৈ করতে পারে। ঝামেলা হওয়ার সম্ভাবনা অনেক। ‘শান্তি কমিটির’ কেউ থাকলে আরও বিপদ। তার থেকে মায়ের সাথে শলা পরামর্শ করে আগানোটাই ভাল। সবাই জালালের কথা মেনে নিল।
জালাল চলল মায়ের কাছে। বাকী বারো জন ছোট শিশুটাকে নিয়ে লুকিয়ে থাকলো সলিমুদ্দিনের খেজুর বাগানের ভিতরে।
১১
ইমাম সদরুল পাশা। বাগানের ভিতর থেকে প্রথমে শুনল কান্নার শব্দ। নিজের চোখে দেখল মানুষ আকৃতির জীন বের হয়ে আসছে সেখান থেকে। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলে ভয় এসে ভড় করলো। অনেক কষ্টে ভো দৌড় দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে হাজির হল আনোয়ারা খালার আঙ্গিনায়। কোন রকমে খালার কাজটা শেষ করে ছুটবে মসজিদে। সেখানে আজ তার মেলা কাজ। কিন্তু খালার বাসার কাছাকাছি আসতে না আসতেই আবার কান্নার আওয়াজ শুনতে পেল। তবে পিছন দিক থেকে না, মনে হচ্ছে খালার বাসার দিন থেকে। খালার বাসায় কোন মহিলা এ সময়ে কান্নাকাটি করার প্রশ্ন উঠে না। নিজের উপর বিরক্ত লাগা আরম্ভ করল। কি যে হল, জায়গায় জায়গায় সে কান্নার শব্দ শুনতে পাচ্ছে। আবার নিজেই কি না জীন, ভূত দেখছে। মানুষে শুনলে কী বলবে।
সদরুল আরেকবার ভূত দেখার মত বিস্মিত হল। আনোয়ারা খালা এক যুবককে জড়িয়ে হাউ মাউ করে কাঁদছেন। তা হলে এবারের কান্নার শব্দটা সত্যি। তার মাথায় ঢুকলো না এইগুলো সব কী হচ্ছে। সে যেয়ে খালার পাশে দাঁড়ালো। খালার বেশ কিছুক্ষণ পরে খেয়াল হল, সদরুল এসে দাঁড়িয়ে আছে। এর মধ্যে দিনের আলো ফোঁটা আরম্ভ করেছে। তার মানে ইতিমধ্যে ফজরের আজান দেয়ার সময়ে পার হয়েছে। খালাকে এ রকম অবস্থায় ফেলে রেখে যেতেও ইচ্ছা করছে না। খালা মাথা উঁচু করে সদরুলকে দেখে কান্নার একটু বিরতি নিলেন। বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে খালা সদরুলকে জড়িয়ে আবার নতুন করে কান্না আরম্ভ করলেন। খালা তাকে নিজের ছেলের মত স্নেহ করেন। এখন খালার কষ্ট ছাড়া মাথার মধ্যে কিছু খেললো না। চেয়ারম্যান সাহেব মসজিদে এসে তাকে না পেলে বড় ধরণের একটা ঝামেলা হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।
খালা ধীরে ধীরে শান্ত হলেন। জালালের সাথে পরিচয় করালেন, “আমার বড় ছেলে”। তার পরে একটু বিরতি নিয়ে বললেন, “জানোয়াররা আমার ছোট ছেলেকে খুন করেছে।” কথাটা শেষ করতে না করতেই, খালার ভিতর থেকে কান্না বের হয়ে আসতে লাগলো। আবার খালা কান্না থামিয়ে জালালের সঙ্গী, যারা খেজুর বাগানে আছে, তাদের কথা জানালেন, “বাবা, তুমি ওদের ব্যবস্থা করো। ওরা যাতে ঠিকঠাক বর্ডার পাড়ি দিতে পারে।” খালা যখন অনুরোধ করছেন, তখন সেই কাজটা করা তার জন্যে শিরোধার্য।
চট করে ফরজের নামাজটা সেরে নিয়ে খালা ও জালালকে বসিয়ে রেখে ইমাম সদরুল পাশা চললো খেজুর বাগানের দিকে। মাঝে রহিম চাচার চায়ের দোকানে একটু বিরতি নিল। সেখানে চাচাকে বলল, “পাশের গ্রামের সখিনার বাড়িতে খবর পাঠাতে যে আনোয়ারা খালা অসুস্থ। নিজেরা ডেলিভারি করাতে না পারলে গঞ্জের ডাক্তারকে যাতে নিয়ে আসে।” কথাটা বলে সদরুলের একটু গ্লানি হল। জীবনে জ্ঞান মত মিথ্যা কথা বলে নি। সে কি এখন মিথ্যা বলল? না সে মিথ্যা বলে নি। খালা ছেলের মৃত্যু সংবাদ এসেছে। উনি তো আসলেও অসুস্থ।
সদরুল পাশা পুরো দলটার বিশ্রামের ও খাবারের ব্যবস্থা করলো। তার বাড়িতে বেশ কিছু চাল, ডাল ছিল। সেগুলো দৌড় মেরে যেয়ে নিয়ে এলো। আনোয়ারা খালা নিজের হাতে খিচুড়ি, ডিম রান্না করে খাওয়ালেন। ছেলেগুলো কত দিন হয়ে গেছে পেট ভরে খায় নি। খালার রান্না করা খাবার ওরা গোগ্রাসে গিলতে থাকলো। তার পরে মনে হয় দুনিয়ার ক্লান্তি ওদের মধ্যে ভর করলো। যে যেখানে জায়গা পেলো, সেখানেই শুয়ে পড়লো। খালা সাদেকের বাচ্চাকে ভালই সামাল দিতে পারলেন। গোসল করিয়ে, খাইয়ে সাদেকের কন্যা ফাতেমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিলেন। অন্যদের মত ফাতেমাও নিশ্চয়ই অনেক ক্লান্ত ছিল সেও একটানে বিকেল পর্যন্ত ঘুমালো।
ইমাম দৌড়ে ছুটে গেল চেয়ারম্যান সাহেবের বাসায়। তাকে মসজিদের চাবি দিয়ে জানালো, জরুরি কাজে গ্রামের বাইরে যেতে হবে। এইবার সত্যি সত্যি সদরুল একটা ডাহা মথ্যা কথা বলল, “ ভিন গ্রামের একজন খালার কাছে একটা মেয়ে শিশু দিয়ে গেছে, কারণ তার পরিবার কোন ভাবেই মেয়ে শিশু মেনে নিচ্ছে না। তবে কিছুদিন পরে পরিবার যদি ভুল বুঝতে পারে, তা হলে এসে বাচ্চাটাকে ফেরত নিয়ে যাবে।”
সদরুল পাশা দলটাকে ঘুরা রাস্তায় খালার বাসায় নিয়ে এসেছিল। গ্রামের কারোর চোখেই পড়ে নি, সেই জন্য দলটার কথা কেউ জানে না। সন্ধ্যা হতেই খালা সবাইকে ডেকে তুললেন। একে একে সবাই গোসল করে নিল। খালা ও সদরুল মিলে পানির ব্যবস্থা করেছিলেন। খালা সবাইকে আবার খাবার দিয়ে বেশ স্নেহ দিয়ে বললেন, “আজকে থেকে তোমরা সবাই আমার ছেলে। আমার ছোট ছেলের হত্যার প্রতিশোধ তোমরা অবশ্যই নিবে।”
রাতটা একটু গভীর হওয়ার সাথে সাথে দলটা খালাকে কদমবুসি করে বের হয়ে পড়লো। সবাই খালার দোয়া প্রার্থী। খালা মন ভরে দোয়া করলেন।
ইমাম সদরুল পাশা খালাকে অবাক করে দিয়ে জানালো, “খালা আমিও দলটার সাথে চললাম। আমিও প্রশিক্ষণ নিয়ে লড়াই করবো। দেশ স্বাধীন করেই ফিরব, ইনশাল্লাহ। এই জুলুম মেনে নিলে, আল্লাহ তা আলা কোনভাবেই বরদাশত করবেন না।”
১২
দেখতে দেখতে দিন গড়াতে লাগলো। সেপ্টেম্বর মাস চলে এলো। বেশীর ভাগ সময়ে ঝুম বৃষ্টি চলতে থাকে। গ্রামে কাজ কর্ম নাই বললেই চলে। পুরুষ মানুষরা ওই পারে চলে গেছে। কিছু মুক্তিযোদ্ধা হয়েছে, বাকীরা উদ্বাস্তু শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে। বাজারে চাল ডালের একেবারে অগ্নি মূল্য। কয়েকদিন পর পরই পাক সেনাবাহিনী গ্রামে এসে অভিযান চালায়। বাড়ি বাড়ি যেয়ে পুরুষ মানুষ ও যুবতি মহিলা খুঁজে। পুরুষ মানুষ শান্তি কমিটির না হলে গুলি করে মারে। যুবতি পছন্দ হলে আর কোন কথা নাই। ক্যাম্পে তুলে নিয়ে যায়। বেজন্মা বেহায়াদের অত্যাচারে গ্রাম প্রায় জনশুন্য হয়ে পড়লো।
আনোয়ারা খালা’র ব্যস্ততা আগের থেকে অনেক কমে গেছে। বাচ্চা প্রসব করানোর জন্য তেমন একটা ডাক আসে না। আসলে পুরো দেশটা এখন ভীষণ ভাবে অসুস্থ। এর মধ্যে বাচ্চা-কাচ্চা নেয়ার মানসিকতা কি আর থাকে? খালার বেশীর ভাগ সময় কাটে ছোট ফাতেমাকে নিয়ে। তাই বা কী কম কাজ? খাওয়ানো, পরিস্কার করানো, ঘুম পাড়ানো সব নিজের হাতেই করতে হয়। মাঝে মাঝে গ্রামের মানুষেরা এসে নানা কথা বলে যায়, “বাচ্চা ফিরিয়ে দিচ্ছেন না কেন? যাদের বাচ্চা তাদেরই ঠ্যাকা। ছেলে হোক মেয়ে হোক তাদেরকেই প্রতিপালন করতে হবে।” কিন্তু খালা কাউকে আসল ঘটনা আর বলেন না।
রহিমপুর গ্রামে মিলিটারি ক্যাম্প না করলেও, শান্তি কমিটি ঠিকই তৈরি হয়ে গেল। চেয়ারম্যান সাহেব তার প্রধান হয়ে গেলেন। কিছু সুবিধাবাদী যুবক রাজাকার হয়ে গেল। পাক বাহিনী তাদের বন্দুক পর্যন্ত দিল। পাক বাহিনীর সব কুকর্মের যেন ডান হাত হয়ে গেল। বাঙালিদের ক্ষতি করার ব্যাপারে পাক বাহিনী থেকে তাদের উৎসাহ আরও বেশী। কেউ ‘জয় বাংলা’ বললেই মনে হয় বিদ্যুৎ গতিতে কথাটা পাক বাহিনীর কাছে পৌঁছে দিত। তবে ‘শান্তি কমিটি’র মূল দায়িত্ব দেয়া হল কোনভাবেই যেন গ্রামে মুক্তিবাহিনী ঢুকতে না পারে। ওদের কোন খবর পেলেই যাতে পাক ক্যাম্পে পৌঁছে দেয়া হয়।
বেশ কিছুদিন ধরে মুক্তিবাহিনীর কথা গ্রামের মানুষের মুখে মুখে ফিরছে। পাক হানাদারদের অবস্থা টাইট করে দিয়েছে। একেবারে বিচ্ছুর কামড়। এক কামড় খেলেই বাকী জীবন বিষ যন্ত্রণায় ভুগতে হয়। কোথাও এদের হাট থেকে রেহাই নাই। শহরে, গ্রামে, গঞ্জে , নগরে, বন্দরে সব জায়গাতেই বিচ্ছুর কামড় চলছে তো চলছেই। তবে সব বার যে সফলভাবে কামড় দিতে পারছে, তা কিন্তু না। মুক্তিবাহিনী ও দেদার মারা পড়ছে পাক হানাদারদের গুলিতে। ধরতে পারলে তো কথাই নাই, এমন অত্যাচার করছে যার কথা শুনলে পেটের নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে আসতে চায়। ছাঁদের থেকে উল্টিয়ে বেঁধে আঙুলের নোক তুলে ফেলে, জ্বলন্ত সিগারেটের ছ্যাকা দিয়ে সারা শরীর পুড়িয়ে ফেলে। তার থেকে আরও কত সব বীভৎস অত্যাচারের কথা বাঙালিরা জ্ঞাত ছিল। কোন মানব সন্তান যে এ রকম কাজ করতে পারে, তার মজির পাওয়া কঠিন’। তার পরেও সব বাঙালির পূর্ণ বিশ্বাস ছিল মুক্তিযোদ্ধারাই একদিন জিতবে। বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই। এর মধ্যে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র স্থাপিত হয়ে গেছে। সুযোগ পেলেই গ্রামের মানুষরা লুকিয়ে ওদের অনুষ্ঠান শুনছে। দেশের গান, কবিতা; মুক্তিযোদ্ধা ও অন্য সব বাঙালিদের সাহস জুগিয়ে আসছে। এম আর আখতার মুকুল তার ‘চরম পত্র’ অনুষ্ঠানে দেশবাসীকে জানিয়ে দিয়েছেন “মোছওয়ালাদের রাজত্ব এখন শেষ বলে।” বিচ্ছুদের কামড়ে কামড়ে একেবারে নাজেহাল অবস্থা। পাক্কুরা যে কোন সময়ে লেজ তুলে দৌড় মেরে পালাতে পারে।
সেদিন ছিল শুক্রবার রাত। সারাদিন ক্লান্তিহীনভাবে বৃষ্টি হচ্ছে। এক জিপ ও দু ট্রাক ভর্তি পাক বাহিনী কিছুক্ষণ আগে চক্কর দিয়ে গেছে। বৃষ্টি বলে হয়ত বাড়ি বাড়ি হানা দেয় নি। আনোয়ারা খালা জায়নামাজে বসে দোয়া-দরুদ পড়ে দু ছেলে, সব মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য দোয়া করলেন। ফাতেমা কিছুটা বড় হয়েছে। মাঝে তার জন্যে দুধ পাওয়া বেশ মুশকিল হয়ে উঠেছিল ভাগ্যিস দু বাড়ি পরে তার দূর সম্পর্কে এক ফুফাতো বোন থাকে থাকে, সেলিমা। ওদের দুটো গাভী আছে। তারা লুকিয়ে দুধ দিয়ে যায়। চেয়ারম্যান সাহেব কিভাবে জানি জানতে পেরেছেন, জালাল মুক্তিযোদ্ধা হয়েছে। একেবারে মুক্তিযোদ্ধাদের কমান্ডার। সম্ভবত পাক হানাদাররা তাকে এই খবর দিয়েছে। চেয়ারম্যান এই জন্যে খালাকে এসে যার পর নাই ভাষায় ভৎসনা করে গেছেন। খালা পরিষ্কার বলেছেন, জালালের সাথে তার বহুদিন কোন যোগাযোগ নাই। তা ছাড়া তার জালাল ঢাকায় থাকে। সে কি করে মুক্তিযোদ্ধা হবে?
খালা বুঝতে কোন অসুবিধা হল না, মুক্তিযোদ্ধাদের কমান্ডার তারই প্রাণ প্রিয় বড় ছেলে জালাল। সে অবশ্যই ভাইয়ের খুনের প্রতিশোধ নিয়ে ছাড়বে। যে ভাই ছোট ভাইকে এত ভালোবাসতো, সে এই কাজ না করে কোনভাবেই বিশ্রাম নিবে না। কিন্তু তার পরেও ছেলেটাকে দেখতে ইচ্ছে করে। ছোট ছেলেটা নাই, এখন জালালই সম্বল। টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ হয়েই চলেছে। খালা রাতে আর ঘুমাতে পারেন না। মনে শুধু ভাবনা আর ভাবনা। তিনি ভাবছিলেন, জালাল এত বৃষ্টির মধ্যে বনে-বাদাড়ে কী করছে, কীই বা খাচ্ছে। ছেলের আধ কপালী মাথা ব্যথার কথা মনে এলো। ছেলে মুক্তিযোদ্ধাদের কমান্ডার। কত বা তার দায়িত্ব ! মাথায় ব্যথা উঠলে ছেলের-ই বা কি হবে, দলের অন্যদের বা কি হবে।
ভাবনা, ক্লান্তির মাঝে মনে হল জালাল তাকে নিচু গলায় ডাকছে, “মা, মা”। খালা সাথে চোখটা খুলে এ দিক ওদিক তাকালেন। বুঝলেন মনের ভুল। হারিকেন জ্বলছে, ফাতেমা পাশে ঘুমাচ্ছে, আগের মতই টিনের চালের উপর বৃষ্টি পড়েই চলেছে। ভোর হতে কতটা যে বাকী, খালা ঠাওর করতে পারলেন না। আরেকবার চোখ লাগাবার চেষ্টা করলেন। মনে হল দরজায় কেউ টোকা দিচ্ছে আর মৃদু গলায় বলছে, “মা, দরজা খোল”। এইবার খালা নিশ্চিত হলেন তার বড় সন্তান দরজায় দাঁড়িয়ে তাকে ডাকছে। খালা যেয়ে দরজা খুলতেই ভিজা শরীরে সাত জন ঘরে পা টিপে টিপে নিঃশব্দে ঘরে প্রবেশ করলো।
জালাল মাকে জড়িয়ে কিছুক্ষণ ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদলো। বাংলার অন্য দামাল ছেলেরা ছল ছল চোখ নিয়ে খালার আমনে দাঁড়িয়ে রইলো। খালা নিজে একই ভাবে কয়েক মুহূর্ত কেঁদে, সবাইকে এক এক করে জড়িয়ে কপালে চুমু দিলেন। বাংলার নির্ভীক ছেলেগুলো বুঝি খালার মধ্যেই নিকের মা দের খুঁজে পেল। দলে মধ্যে সাদেক ও সদরুল দু জনেই ছিল। সাদেক ফাতেমাকে কোলে নিয়ে কত না বিলাপ করলো, “বাছারে এখনও তার মা কে উদ্ধার করতে পারলাম না। বেচারি বেঁচে আছে, না মরে গেছে; তাই জানি না। তুই আমাকে মাফ করিস রে মা।” অন্যদিকে সদরুলকে একেবারেই চেনা যাচ্ছে না। আগের সেই সুন্দর শ্বশ্রূমণ্ডিত চেহারা হারিয়ে গেছে। অযত্নে মুখ ভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি। পরনের পায়জামা-পাঞ্জাবির জায়গায় লুঙ্গি-গেঞ্জি। সবারই কাঁধে রাইফেল। কয়েকজনের সাথে শক্ত ক্যানভাস কাপড়ের ঝোলা। সেখানে হয়ত আছে গুলি, বোমা, গ্রেনেড।
খালা তাড়াতাড়ি স্নেহ পর্ব শেষ করে নেমে পড়লেন মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার আয়োজনে। ঘরে খাবার বলতে তেমন কিছু ছিল। ভাত চড়িয়ে দিলেন। কয়েকটা বেগুণ ছিল, সেগুলো ভাজলেন। রান্না শেষ করে যখন তিনি ফিরলেন, সবগুলো মুক্তিযোদ্ধা তখন ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের কন্যা ফাতেমা মৃদু আলোয় সবার দিকে তাকিয়ে আছে। সবাইকে সে বুঝি আদর-সোহাগে আঁকড়ে রাখতে চাচ্ছে। ওদের ডেকে খালা বলতে চাইছিলেন, “বাছারা উঠো। মুখ হাত ধুয়ে ভাত খেয়ে নাও।” না খালার ওদের উঠাতে ইচ্ছা করলো না। তিনিই বড় এক থালায় করে রান্না করা খাবার নিয়ে এলেন। তার পর এক জন করে সাত জন ঘুমন্ত মুক্তিযোদ্ধার মুখে খাবার তুলে দিলেন। ক্লান্ত যোদ্ধারা চোখ খুললো না, শুধু মুখটা খুলে খাবার নিল। মা পাশে থাকলে সন্তানের কি কোন ভয় থাকতে পারে? মা’ই সব সময়ে রক্ষা করে চলেছেন। তিনি এখনও করবেন। খাওয়া শেষ করে ছেলেগুলো আরামে ঘুমাতে লাগলো।
ভোরের আলো ফোঁটার আগে এক এক করে সবাই উঠে পড়লো। কমান্ডার জালাল মাকে জানালো, তাদের বিভিন্ন দুঃসাহসিক সব অভিযানের কথা। একবার মাথা নিচু করে চোখের পানি মুছতে মুছতে বলল, “ওই যে ঢাকার বিক্রমপুরের ছেলে ফরিদ, বাবা-মার কাছে না যেয়ে আমার সাথে এসেছিল যুদ্ধে যাবে বলে, সে গত সপ্তাহে পাক বাহিনী সাথে সামনাসামনি এক যুদ্ধে শহীদ হয়েছে। অবশ্য গুলি খেয়েও নিজে গুলি চালালো বন্ধ করে নি। তার পরেও কমপক্ষে দশটা জানোয়ার মেরে, নিজে মরেছে। সে গুলি চালাচ্ছিল বলেই অন্য মুক্তিযোদ্ধারা জীবন নিয়ে সরে আসতে পেরেছিল। ফরিদের লাশটা পর্যন্ত আনা যায় নি। পুরো জায়গাটা হানাদাররা ঘিরে ফেলেছিল।” সাদেক আনোয়ারা খালাকে মা বলে সম্বোধন করে, “মা এখানে আসার আগে তিন গ্রাম পরে কপোত নদীটার উপরে যে ব্রিজ ছিল, সেটা উড়িয়ে দিয়ে এসেছি।” মা তার দিকে কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, “সাবাস ব্যাটা, তোরাই পারবি। তোদের গর্বে আমার বুক বুক ফুলে ইয়া বড় হয়েছে !”
দল নিয়ে বের হওয়ার সময়ে কমান্ডার জালাল মাকে ফিসফিস করে বলল, “মা, আগামী শুক্রবার আমরা আবার আসবো। আমাদের খবর আছে, শুক্রবার সকালে রহিমপুরে মিলিটারি ক্যাম্প করবে। ওই দিন রাতেই আমরা ওদের আক্রমন করে ধ্বংস করে দিব। তার পরে আমরা দশ জন এখানে আসবো। পারলে খিচুড়ি, ডিম রেঁধো। খেতে খুব ইচ্ছা হয়। কিন্তু খবরদার কাউকে বলবে না।”
কিছুক্ষণের মধ্যেই দলটা অন্ধকারে হারিয়ে গেল।
১৩
শুক্রবার সকাল। আনোয়ারা খালা সকাল থেকেই মহা ব্যস্ত। মেলা কাজ। ছোট ফাতেমাকে দিয়ে এসেছেন বোন সেলিমার কাছে। বলে এসেছেন পরের দিন বাচ্চাটাকে ফেরত নিয়ে আসবেন। বাসায় দশজন খাবে। চাল বাসাতেই ছিল। গতকাল কাজী বাড়ি থেকে বেশ কিছু ডাল নিয়ে এসেছেন। কাজী বাড়ির সব বাচ্চা তার হাতে হয়েছে। একেবারে আত্মীয়ের মত সম্পর্ক। গেলেই খালাকে চাল, ডাল, লবণ দিয়ে দেয়। ওরা জানে খালা একা থাকে। আয় রোজগার তেমন নাই। এইবার খালা বলে একটু বেশী করে ডাল নিয়ে এলন, “বাসায় একটা বাচ্চা। ওকে রেখে বাইরে আসা মুশকিল। তাই একটু বেশী করেই দাও।”
আজকে বৃষ্টিটা অন্য ধরণের। ভারী বৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু তার পরেও মাঝে মাঝে বিরতি। যদিও ওরা অনেক রাতে আসবে। তার পরেও খালা উঠান ঝাড়ু দিয়ে খুব যত্ন নিয়ে পরিষ্কার করলেন। ঘরের আসবাবাবপত্র থেকে আরম্ভ করে থালা বাসন ঝকঝকে তকতকে করলেন। ঠিক করলেন বিকাল নাগাদ খুচুরি চড়িয়ে দিবেন। খাবার তৈরি হয়ে গেলে, নামাজ পড়ে দোয়া-দরুদ পড়তে থাকবেন। আল্লাহ’র কাছে একেবারে ভিতর থেকে প্রার্থনা করবেন, “ইয়া আল্লাহ আমার বীর বাচ্চাগুলো যেন জিততে পারে। সবগুলো মানুষরূপী শয়তান পাক সেনাগুলো যাতে হেরে যায়।”
হঠাৎ মনে হল আরে ছেলেটা না ডিম দিয়ে খিচুড়ি খেতে চেয়েছিল। চাল, ডাল আছে, কিন্তু ডিম তো আনা হয় নি। এর মধ্যে আবার ঝুম বৃষ্টি আরম্ভ হয়েছে। মুশকিল হয়ে গেল। কি করা যায় এখন। বাড়িতে দশ টাকা ছিল। সেটা নিয়ে খালা ছুটলেন করিম মুনশির দোকানে। খালা শুনেছেন, করিম চেয়ারম্যান সাহেবের শান্তি কমিটিতে নাম লিখিয়েছে। তাকে চেয়ারম্যান সাহেব একটা বন্দুকের ব্যবস্থা করে দিবেন। থাক ওই সব চিন্তা করার সময় নাই। খালা মাথায় গামছা পেঁচিয়ে ছুটলেন দোকানের দিকে।
করিম মুনশি দোকানে কোন ক্রেতা ছিল না। সে মাথা নিচে করে একটা কাগজে হিজিবিজি একে সময় কাটাচ্ছিল। সে তো খালাকে দেখে একেবারে অবাক, “আপনি এই বৃষ্টির মধ্যে?” খালা তাড়াহুড়া করে বললেন, “এক ডজন ডিম দাও গো বাবা।” দোকানী অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো, “এত ডিম দিয়ে কি করবেন গো খালা?” খালা বললেন, “কাজ আছে রে বাবা।” করিম একটা ঠোঙ্গায় দিন ভরা আরম্ভ করলো, “খালা দশটা ডিম আছে, এক ডজন তো নাই।” মনে হল খালা কি একটা হিসেব করলেন, “তাই দাও গো মিয়াঁ। দশটাতেই চলবে।”
কমান্ডার জালালের মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে আজ টানটান উত্তেজনা। খুব গুরুত্বপূর্ণ অপারেশন করতে হবে। সবাই অস্ত্র, শস্ত্র, গোলা-বারুদ নিয়ে রেডি। গত কয়েকদিনে কার কি দায়িত্ব, সে সব নিয়ে প্রচুর মহড়া দিয়েছে। তাকে আজকে পারতেই হবে, জিততেই হবে। কিন্তু জালাল অন্য একটা ব্যাপার নিয়ে চিন্তিত, কিন্তু কাউকে বলছে না। আজকে সকাল থেকে আধ কপালী মাথা ব্যথা আরম্ভ হয়েছে। তবে সে ঠিকই কাউকে বুঝতে না দিয়ে ব্যথাটা সামাল দিচ্ছে। বিকাল নাগাদ ব্যথা ঠিক হয়ে যাবে, অপারেশনে অবশ্যই যাবে। তবে সমস্যা আরেক জায়গায়। এই ব্যথা উঠলেই না খারাপ খবর আসে। কমান্ডার জালাল মনটাকে শক্ত করে নিল, “নাহ, এই কুসংস্কারে বিশ্বাস করলে চলবে না। আজকে তারা অবশ্যই জিতবে। হারার কথা মাথার মধ্যেই ঠায় দিবে না।”
সন্ধ্যা হতেই আবার এক নাগাড়ে ঝুম বৃষ্টি আরম্ভ হল। বৃষ্টি সারা রাতে থামবে বলে মনে হয় না। খালাও বৃষ্টির সাথে তাল মিলিয়ে ছেলেগুলোর জন্যে দোয়া করতে লাগলেন। মাঝ রাতের দিকে গ্রামের খেলার মাঠের দিক থেকে তুমুল গুলি শব্দ আসা আরম্ভ করলো। প্রথমে মনে হচ্ছিল, শুধু এক পক্ষ গুলি করছে। পড়ে অন্য দিন গুলির শব্দ আসতে লাগলো। গুলিতে গুলিতে কথোপোকথন। শেষে বিকট শব্দে বোমা, গ্রেনেডের শব্দ আসতে লাগলো। সব মিলিয়ে ঘণ্টা দুয়েক যুদ্ধ চললো। শেষে গুলি, বোমার শব্দ কমতে কমতে বন্ধ হয়ে গেল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই তিন জন মুক্তিযোদ্ধা খালার বাড়িতে ঢুকলো। এত বড় একটা সফল অভিযান করে এসেছে। তার পরেও সবার মাথা উঁচু, মুখ থমথমে। খালা জানতে চাইতেই, জালাল জানাল যে ওরা দশ জন এসেছিল। সাত জন মারা গেছে। তাদের মধ্যে একজন ইমাম সদরুল পাশা। এইবার খালা কান্না আরম্ভ করলেন। মা, ছেলেরা সমস্বরে কাঁদতে থাকলো। এই স্বাধীনতার জন্যে এত মূল্য দিতে দিচ্ছে? এত স্বপ্নকে অকালে নিহত হতে হচ্ছে। ইমাম সদরুলের পাশার আর মসজিদের সাইন বোর্ডে নিজের নামটা দেয়া হল না। বাকী ছজন মুক্তিযোদ্ধা কে জানে কত না স্বপ্ন নিয়ে হারিয়ে গেল। শুধু সাত জন তরুণ মুক্তিযোদ্ধাই না, সাতটা স্বপ্ন অকালে খুন হল।
ক্ষুধা থাকলেও, ডিম, খিচুড়ি তেমন একটা কেউ খেতে পারলো না। জালাল মা’কে বলল, তারা দু ঘণ্টার জন্যে ঘুমাবে। খালা যাতে আগের বারের মত ঘুম থেকে সময় মত তুলে দেয়। কথা শেষ হতে না হতেই ছেলেগুলো ঘুমিয়ে পড়লো। খালা পরম স্নেহে ছেলে গুলোর তাকিয়ে রইলেন। কি অসম সাহসী এই ছেলেগুলো। পাক হানাদারদের উচিত শিক্ষা দিচ্ছে। আল্লাহ ওদের ভাল করুন।
আনোয়ারা খালার মনে হল, তার উঠানে ফিসফিস করে কেউ কথা বলছে। প্রথমে কানের ভুল বলে মনে হল। এই দিকে ঝুম বৃষ্টির শব্দ হয়েই চলেছে। এক মিনিট বিরতি নিয়েই, আবার কিছু মানুষের কথা বার্তা ও বুটের শব্দ শোনা গেল। সাথে শোনা গেল, করিম মুনসীর আপ্রাণ চেষ্টা করে উর্দু বলার প্রচেষ্টা, “ইয়ে ঘরমে দশ মুক্তিযোদ্ধা হ্যায়। খালা আজ দশ ডিম কেনা হ্যায়।”
আনোয়ারা খালা মুহূর্তেই বুঝে ফেললেন বিষয়টা। সাথে সাথে চিৎকার করে বললেন, “পালাও, পালাও। মিলিটারি চলে আসছে। ওই জানালা দিয়ে বের হয়ে পুকুরে লাফ দাও।” ক্যাম্পে আক্রমণের সাথে সাথে পাক সেনাগুলো সাহায্য চেয়েছিল। তারা কিছুক্ষণ আগে রহিমপুর এসে পৌঁছেছে। করিম মুনশী হানাদারদের খালার বাসার পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছে। ছেলেরা কিছু বুঝার আগেই এক মিলিটারি বন্দুক উঁচিয়ে লাথি মেরে দরজা ভেঙ্গে ঢুকলো। ছেলেদের দেখা মাত্রই হানাদার গুলি করলো। আনোয়ারা খালা অসম্ভব একটা কাজ করলেন। বন্ধুক দিয়ে গুলি বের হওয়ার আগে তিনি বন্দুকের সামনে যেয়ে দাঁড়ালেন। এক ঝাঁক গুলি তার বুক ঝাঁঝরা করে দিল। খালা মুহূর্তের মধ্যেই রক্তাক্ত হয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়লেন। ছেলেরা এর মধ্যে জানালা থেকে বের হয়ে পুকুরে লাফ দিয়ে ডুব সাঁতার দিল। এক জন বাঙালি মা নিজের প্রাণ দিয়ে তার তিন মুক্তিযোদ্ধা সন্তানের প্রাণ রক্ষা বাঁচালেন।
হঠাৎ ভীষণ জোড়ে আসে পাশে কোথাও একটা বাজ পড়লো। খালার রক্তাক্ত শরীর আলোকিত হয়ে উঠলো। আবারও চারিদিক অন্ধকার হয়ে গেল। তিন বাঙালি তরুণ অন্ধকারে উধাও হয়ে গেল। পাক্কুরা ওদের আর ওদের খুঁজে পেল না। তাদের এখন অনেক দায়িত্ব। ভাই হত্যা, বোনের অপহরণ-ধর্ষণ, গণহত্যা, শোষণের প্রতিশোধ তো তাদের নিতে হবেই।
সেপ্টেম্বর ৫, ২০১৬
কাজী হাসান
প্রবাসী লেখকঃ quazih@yahoo.com