কেঁদে যায় দখিন হাওয়া
প্লেনে উঠার অপেক্ষায় আছি। প্রথমে বিজনেস ক্লাস ও ফাস্ট ক্লাসের যাত্রীদের পালা। তার পরে আমার মতো সাধারণ যাত্রীদের সুযোগ। সাধারণ জনগণদের আবার অ-সাধারণভাবে উঠতে হয়। বিমানের পিছন দিক থেকে জোন আরম্ভ হয় এবং সেইভাবে যাত্রীরা উঠে। টিকেটের মধ্যে জোন নাম্বার দেয়া থাকে। আমি আমার জোনের লাইনে দাঁড়ালাম। তাকিয়ে দেখি বেশ কিছু জোন ভিত্তিক লাইন হয়েছে। পরিচিত কোনো মুখ চোখে না পড়ায় ঈষৎ হতাশ হলাম। ভাবছিলাম কতক্ষণে প্লেনে যেয়ে আসন গাড়বো। হঠাৎ বাংলা কথা শুনলাম। আমার পাশের লাইনের মাঝ বয়সী এক ভদ্রলোক খাঁটি বাংলা ভাষায় তার পেছনের লোককে জিজ্ঞাসা করছেন, “আপনি কি বাংলাদেশী।” যাকে প্রশ্ন করেছেন সে অবাক হয়ে প্রশ্নকর্তার দিকে তাকিয়ে আছেন। মুহূর্তেই বুঝে নিলাম ভদ্রলোক ভুল মানুষকে বাঙালি বলে ঠাওর করেছেন।
পাশের লাইন থেকে আমি বললাম, “এই যে ভাই আমি বাঙালি।” বিদেশে দুই বাঙালির দেখা হলে যা হয় সেটাই হলো। অল্প সময়ে মেলা কথা হয়ে গেল। তিনি মধ্যপ্রাচ্যের এক বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘ সময় ধরে শিক্ষকতা করছেন। এমেরিকায় এসেছিলেন এক কনফারেন্সে। ডালাসে তার বড় মেয়ে থাকে। তার সাথে কয়েকটা দিন কাটিয়ে আরব দেশে ফিরছেন। আমরা ফোন নাম্বার বিনিময় করলাম। কথা হলো আমাদের মধ্যে যোগাযোগ থাকবে। এর মধ্যে আমার লাইন এগুনো আরম্ভ করলো। ভদ্রলোককে শেষ প্রশ্ন ছুড়ে দিলাম, “ভাই আপনি ওই ভারতীয়কে বাঙালি ভাবলেন কেনো?” উত্তরে তিনি জানালেন, দীর্ঘ দিন বিদেশে থাকলেও তোর চোখ সব সময় বাঙালি খুঁজে বেরায়। তবে ভারতীয়দের বাঙালিদের সাথে চেহারা ও আকৃতির বেশ সামঞ্জস্য থাকার কারণে কখনও সখনও ভুল হয়ে যায়। শেষে একগাল হেসে উপসংহার টানলেন, “বলতে পারেন বাঙালি চেনায় আমার সাকসেস রেট ৯০%।” মনে মনে ভাবলাম আমি তো উনার ১০০ ভাগ ফেলিয়ার রেট চাক্ষুষ করলাম।
বিশাল প্লেনে উঠার পর আর উনাকে খুঁজে পেলাম না। দুবাই থেকে উনি যাবেন আরবে আর আমি যাবো বাংলাদেশে। বিমান থেকে নেমে ইনফরমেশন বোর্ডের সামনে যেয়ে পরের ফ্লাইটের বৃত্তান্ত খুঁজতে লাগলাম। তাকিয়ে দেখি সেই ভদ্রলোক আমার পাশে দাঁড়িয়ে একই কাজ করছেন। দুবাই এয়ারপোর্টে ব্যাপক কন্সট্রাকশান চলছে। আমরা নতুন টার্মিনালে ল্যান্ড করেছি। আমাদের টার্মিনাল পাল্টাতে হবে। সে জন্যে বাস ধরতে হবে এবং পনেরো মিনিট সময় লাগবে। আমরা কেউ এই খবরের জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। আমি আগেও কয়েকবার দুবাই এয়ারপোর্ট ব্যবহার করেছি। কখনই অন্য টার্মিনালে যেতে হয় নি। শুধু ভিন্ন গেটে যেতে হয়েছে। সাথী ভদ্রলোক বললেন তিনি বহুবার এখানে এসেছেন, কিন্তু টার্মিনাল বদল তার জন্যেও প্রথম। তবে দু জনের চূড়ান্ত গন্তব্য ভিন্ন হলেও, আমাদের দু জনকে একই টার্মিনাল থেকে পরের প্লেন ধরতে হবে।
দুই বঙ্গ সন্তান রওয়ানা দিলাম পরবর্তী টার্মিনালের খোঁজে। তেমন কোনো সাইন দেখলাম না, যার থেকে বুঝতে পারি কোথা থেকে বাস ছাড়বে। আমরা এই দিক ওই দিকে তাকাচ্ছি আর গুটি গুটি পায়ে এগুচ্ছি। অচেনা জায়গায় কোনো ঝামেলায় যাতে না পারি, সে জন্য একটু বেশীই সাবধান হয়ে পড়লাম। হঠাৎ শুনি বাংলা কথা। আমার বাঙালি সহযাত্রী অন্য একজনকে বাঙলায় জিজ্ঞাসা করছেন, “কিভাবে টার্মিনাল ‘সি’ তে যেতে হয়?” এইবার উনাকে হতাশ হতে হলো না। তাকিয়ে দেখি এয়ারপোর্টের পোশাকধারী একজন খাস বাঙালি। উনি হয়তো এয়ারপোর্টের মেন্টেনেন্সের কাজ করেন। মধ্যপ্রাচ্যে অল্প বেতনের কায়িক শ্রমের কাজগুলো বাঙালিরাই করে। যাই হোক, তিনি হাত পা নেড়ে খুব আগ্রহ নিয়ে সুন্দর করে বুঝিয়ে দিলেন কিভাবে বাস নিয়ে আমরা টার্মিনাল ‘সি’ তে পৌঁছতে পারি। আমিও কথাগুলো শুনে নিলাম। একটু আশ্বস্ত বোধ করলাম। এই বার প্লেনের সহযাত্রী ভাই আমার দিকে তাকিয়ে বেশ উৎসাহিত হয়ে বললেন, “দেখলেন আমি ঠিকই বাঙালী চিনেছি। বলেছি না আমি ৯০% ভাগ সময়ে নির্ভুলভাবে বাঙালি চিনে ফেলি।” আমি একটু রসিকতা করার চেষ্টা করলাম, “দু জনের মধ্যে এক জনকে চিনতে পেরেছেন। তা হলে হয় ৫০%। আপনার ৯০% দাবী করাটা ঠিক হচ্ছে না।” কথাটা শেষ না হতে না হতেই আমাদের খুব হাসি পেলো। দু জনেই এক চোট হেসে নিলাম। এর মধ্যে বাঙালি ত্রাণকর্তা সময় নষ্ট না করে আমাদের অগোচরে নিজের মতো চলে গিয়েছেন। খারাপ লাগলো যে একজন আমাদের এতো বড় একটা উপকার করলো, তাকে আমরা কি-না একটা ধন্যবাদ পর্যন্ত দিলাম না। নিজের উপর বেশ বিরক্ত হলাম। আমার এ রকম ভুল করাটা মেনে নেয়া যায় না।
বিরক্ত-ভাবটা বেশীক্ষণ স্থায়ী হলো না। অল্প বয়স্কা জিন্স, টি-শার্ট পরা সুন্দরী তন্বী একজন মেয়ে হেঁটে আসছেন। চোখে, মুখে ও শরীরের ভাষায় স্পষ্ট নার্ভাসনেস। আমার ক্ষুদ্র মস্তিষ্ক বৃহৎ একটা পর্যবেক্ষণ করে ফেললো। আমি একেবারে নিশ্চিত মেয়েটা বাঙালি এবং সে বুঝার চেষ্টা করছে কিভাবে ‘সি’ টার্মিনাল যাওয়া যায়। আমি আমার বাঙালি ভাইকে বেশ আস্থার সাথে বললাম, “মেয়েটা বাঙালি...।” ভদ্রলোক খুব একটা নিশ্চিত হতে পারলেন না। তার পরেও উনিও আমার মতো দাঁড়িয়ে পড়লেন। মেয়েটা কাছে আসতেই আমি বাংলাতেই বললাম, “আপনি কি ‘সি’ টার্মিনাল যাবেন? তা হলে আমাদের সাথে আসতে পারেন। সুন্দরী মেয়েদের সংশয় এমনিতেই বেশী থাকে, তার পরে বিদেশ বিভূঁই। এইবার আশা করছিলাম সে আমাকে কিছু টুকটাক প্রশ্ন করবে। নাহ তার মিষ্টি গলা শোনার সুযোগ হলো না। কিছু না বললেও, আমাদের দু জনের পিছনে পিছনে সুন্দরীও খুব সাবধানতার সাথে হাটা আরম্ভ করলো। হয়তো সে বিশ্বাস করতে পারছে না অপরিচিত দু জন বাঙালি তাকে গায়ে পড়ে সাহায্য করছে! শেষে আবার কোনো সমস্যায় না পরে যায়। এইদিকে আমাদের দু জনের কথা বার্তা বেশ কমে আসলো। কারণ ভদ্রলোকও বুঝে ফেললেন সুন্দরী ললনা আমাদের ভরসা করে পারছে না। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্যে উনাকে আমি ফিস ফিস করে বললাম, “আমার কিন্তু বাঙালি চেনার সাকসেস রেট ১০০%।” প্রতি উত্তরে উনি আমাকে একটা শুকনো হাসি উপহার দিলেন। যাই হোক বাঙালি ললনা আমাদের অনুসরণ করে টার্মিনাল ‘সি’ পর্যন্ত আসলেন। তার পরে হঠাৎই পিছন থেকে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। গায়ে পড়ে উপকার করার জন্যে “ধন্যবাদ” বা ছোট্ট শব্দ থ্যাঙ্কু সুন্দরীর গলা থেকে শোনা হলো না! বিদ্যাসাগরের “উপকার করলেই শালা ডাকে” কথাটা মনে করে আশ্বস্ত হলাম। আর যাই হোক উপকার করার জন্যে বাড়তি কোনো ঝামেলায় তো আর পড়তে হয় নি! তাই বা কম কি-সে!!
ঢাকা এয়ারপোর্টে রাত এগারোটায় নামলাম। জন্মভূমিতে ফিরে আসার আনন্দ ও উত্তেজনা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। শুনলাম দেশে এখন অর্থনৈতিক প্রাচুর্য চলছে। জীর্ণ ঢাকা বিমানবন্দর দেখে মুহূর্তেই দমে গেলাম। চারিদিকে অগণিত মানুষ। তার পরে তেমন রক্ষণাবেক্ষণ করার কোনো প্রমাণ পেলাম না। বিশৃঙ্খলার কমতি নাই। এই এয়ারপোর্টকে নিয়ে এক সময়ে কত না গর্ব ছিল। সারা পৃথিবী এগিয়ে গেছে, কিন্তু এই জায়গাটা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। এতো বিশাল সংখ্যক যাত্রী এখান থেকে প্লেনে উঠা-নামা করে। তারা সবাই পয়সা দিয়েই বিমান বন্দর ব্যবহার করে। তার পরেও কেন এই দশা?
সাথের মোবাইল ফোনটা অন করলাম। আমি ধরেই নিয়েছিলাম পৃথিবীর অন্যান্য এয়ারপোর্টগুলোর মতো এখানে জনগণের জন্যে wifi থাকবে। সেটা ব্যবহার করে আমাকে যারা নিতে আসবে তাদের সাথে যোগাযোগ করবো। না সে আশায় গুড়ে বালি। নো পাবলিক wifi. আমি বিমানের টিকেটের সাথে বিমানবন্দরের সুযোগ সুবিধার জন্য সব ধরণের ফি দিয়েছি বলেই জানতাম। কিন্তু বাংলাদেশের বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ একজন যাত্রী আধুনিক বিমানবন্দরের যে সুযোগ সুবিধাগুলো আশা করতে পারে, তার থেকে আমাকে বঞ্চিত করলো। টাকা নিচ্ছে, সার্ভিস দিচ্ছে না। নাহ, ধন্যবাদ দিতে পারলাম ন!
এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে এক হট্টগোলের মধ্যে পড়লাম। মানুষের ভিড় তো আছেই। ট্যাক্সি প্রয়োজন আছে কি-না জানতে বেশ কয়েকজন টানাটানি করলো। আমি শক্ত করে জানিয়ে দিলাম আমাকে নিতে গাড়ি আসবে। এর মধ্যে মাঝ রাত হয়ে গেছে। বাইরের টিপি টিপি বৃষ্টি আমাকে স্বাগত জানালো। অনেকদিন পর বাংলাদেশের বৃষ্টি দেখলাম। নিমিষেই সব ক্লান্তি উবে গেল। ভাবলাম, এই আকাশ, বৃষ্টি আর দেশটাকে ভালোবাসি বলেই তো বারংবার এতো ভোগান্তি সহ্য করে এখানে ফিরে আসা। রাস্তার অন্যদিকে রেলিং দেয়া। সেখানে প্রিয়জনদের যারা নিতে এসেছেন তাদের ভিড়। আমি সে দিকে চোখ দিলাম। না আমার যেই ভাইয়ের আসার কথা ছিল তার দেখা মিললো না। মোবাইল ফোনে বাংলাদেশের সিম নাই। তাই সেটা ব্যবহার করতে পারছি না। বিমান বন্দরের ভিতরে wifi না থাকার জন্যে প্ল্যান মোতাবেক ফোন করতে না পারার জন্যে বলতে পারি নি যে আমি চলে এসেছি এবং আমি গাড়িতে উঠার জন্যে প্রস্তুত।
অপেক্ষায় থাকলে মনে হয় সময়ও ধীর গতিতে চলে। প্রায় আধা ঘণ্টা সময় পার হয়ে গেল। বিরক্তি বাড়তে লাগলো। ভাবছি কি করা যায়। আবারও একজন এসে জানতে চাইলো ট্যাক্সি লাগবে কি -না। আমি তাকে জানালাম ট্যাক্সি লাগবে না। তবে তাকে বললাম, উনি যদি আমাকে তার মোবাইল ফোনটা ব্যবহার করতে দেন তা হলে খুবই উপকার হয়। উনি নির্দ্বিধয় পকেট থেকে নিজের ফোনটা বের করে বললেন, “আপনার নাম্বারটা দিন।” আমি ফোনে কথা বলে আমার সমস্যার সমাধান করলাম। উনাকে ধন্যবাদ দিয়ে কিছু টাকা (ডলার) দেওয়ার জন্যে হাত বাড়িয়ে দিলাম। উনি কোনভাবেই তার ফোন ব্যবহারের জন্যে যে খরচ হয়েছে সেটা নিলেন না। একজন স্বল্প আয়ের মানুষ আমাকে সাহায্য করে অনাবিল প্রশান্তি পেলেন। তাকে অর্থ দিয়ে এর থেকে বঞ্চিত করা অসম্ভব। উনাকে বললাম, “আপনার জন্যে শুধু ধন্যবাদ না, দোয়াও থাকলো। সৃষ্টিকর্তার আপনার অনেক মঙ্গল করুক।”
খেঁটে খাওয়া বাঙ্গালীরা কত সহজেই না অন্যের সাহায্যে এগিয়ে আসে। দুবাই এয়ারপোর্টের সেই স্বল্প-উপার্জনকারী কর্মচারী কিংবা যে ঢাকা বিমানবন্দরে ট্যাক্সি ডেকে দেওয়ার কাজ করছে, সে অন্যকে সাহায্য করতে নিজের সময় কিংবা নিজের অর্থ খরচ করে অন্যদের সাহায্য করতে পিছপা হচ্ছে না। এরাই বাংলাদেশের মূল চালিকা। এরাই দেশে ও বিদেশে নির্মম দয়া-মায়া-বিহীন পরিবেশে শ্রম দিচ্ছে, দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখছে। তাদেরকে আমার হ্রদয়ের অন্তঃস্থল থেকে, ‘ধন্যবাদ, ধন্যবাদ’। কিন্তু দুঃখজনক যে যারা ক্ষমতাধর ও বিত্তবান, যারা কথিত ‘জনগণের সেবক’, যারা বাংলাদেশের উন্নতির সব কৃতিত্ব দাবী করে, যারা বিরতিহীনভাবে নিজের আখের গুছিয়ে চলেছে, তারা পরিবর্তিত বিশ্বে সাধারণ মানুষের অধিকার নিয়ে বিন্দু মাত্র তোয়াক্কা করে না। এখন আপনারাই বলেন, এই সব লুটেরারা কি কারোর ‘ধন্যবাদ’ পাওয়ার যোগ্য?
ও আচ্ছা একজনের কথা বলাই হয়নি। মনে আছে নিশ্চয়ই ওই যে সুন্দরী বাঙালি তন্বী মেয়েটার কথা। আমাদের দুবাই এয়ারপোর্টে “ধন্যবাদ” না দিয়ে উধাও হয়ে গিয়েছিল। তাকে নিয়ে কিন্তু আমার মেলা কথা বলার আছে। সেটা না হয় আরেক দিনের জন্যে তুলে রাখি। কি বলেন? লেখাটা পড়তে পড়তে এতোক্ষণে তো আপনাদের ক্লান্ত হয়ে যাবার কথা?
তবে যাই হউক, এই লেখাটা পড়ার জন্যে আপনাদের সবাইকে অশেষ “ধন্যবাদ”।