গদ্যের আবেদন কি একবার পাঠ করার পরই শেষ হয়ে যায়? চমৎকার কবিতাগুলো বার বার পড়া হয় কিংবা জনপ্রিয় গানগুলো মানুষের মুখে মুখে বছরের পর বছর থেকেই যায়। হয়ত আয়তন দীর্ঘ হওয়ার কারণে গদ্যের একই ভাগ্য হয় না। কিন্তু লেখক সময় নিয়ে প্রচুর সমস্ত আবেগ দিয়ে সৃজনশীল কাজটা করে থাকেন। আমার মতে গদ্যের জন্যও একই ধরণের গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টি হলে হয়তো ভালো হতো। লেখা একাধিকবার পড়া হলে লেখকের পরিতৃপ্তির পরিধি বাড়তো। তারাও আশা করে পাঠক আত্মস্থ করে বিষয়বস্তু নিয়ে যাতে আলোচনা চালিয়ে যায়। আমি নিজে তেমন বড় কোনো লেখক না। তারপরেও আমি নীচের দুটো লেখাকে এক করে দ্বিতীয়বার তুলে ধরছি। আশা করছি লেখাটা আপনাকে ক্ষণিকের জন্য হলেও থমকে দিবে। বাবার সাথের কিছু স্মৃতি চোখের সামনে নিয়ে আসবে।
(বি.দ্র.- এক বসায় পড়া শেষ করতে না পারলে আরেকবার ফিরে আসার অনুরোধ রইলো)
১. আমার বাবার কথা
ফাদার্স ডে। বাংলা করলে হবে বাবা দিবস। আর কয়েক দিন পরেই । মা হারিয়েছি আজ বেশ কিছু বছর হলো। বুঝেছি প্রতিটা বিশাল কর্মকাণ্ডেরই পরিসমাপ্তি থাকে। তার পরেও আমাদের বেঁচে থাকতে হয়, স্বপ্ন দেখতে হয় এবং ভালোবেসে সেটা ছড়িয়ে দিতে হয়। সেই ভালোবাসা ছড়িয়ে দেবার তাগিদ থেকেই বাবা দিবসে বাবাকে নিয়ে কিছু লেখার চেষ্টা করছি। বিষয়বস্তুটা নিয়ে ভাবতেই কত শত স্মৃতি না এসে ভিড় করছে; বাবাকে নিয়ে, মাকে নিয়ে, পরিবারের সবাইকে নিয়ে।
বয়স তখন আমার পাঁচ-ছয় । গাড়িতে করে রাজশাহী থেকে ঢাকা আসছি। ফেরি ঘাটে এসে গাড়ি দাঁড়াল। লাইনের প্রথম দিককার গাড়িগুলো ফেরিতে উঠছে। তার পরে বাকী গাড়িগুলোর অপেক্ষার পালা। ফেরি ঘাটে বিভিন্ন ধরণের খাবারের দোকান। ক্ষুধার্তরা যে যার মত খাবার কিনে খাচ্ছে। আমরাও এক সুন্দর পরিষ্কার রেস্টুরেন্ট দেখে ঢুকে পড়লাম।
অন্যরা কে কি অর্ডার দিয়েছিল, সেটা এখন আর আমার মনে নাই। কিন্তু আমার নিজের অর্ডারটা, এত দীর্ঘ দিন পরেও স্পষ্ট মনে আছে। আমার খেতে ইচ্ছে হয়েছিল, আমার সেই সময়কার প্রিয় খাদ্য, ভাতের সাথে দুধ-আম। রেস্টুরেন্টে ভাত থাকলেও আম- দুধ ছিল না। আমাকে বলা হলো অন্য কিছু খেতে। কিন্তু আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল। প্রথমে মিষ্টি করে বললো, তার পরে চোখ রাঙ্গিয়ে, শাসালো, বাছা তুমি অন্য কিছু খাও। সেই বয়সে যা হয়, আমি আমার প্রিয় খাদ্যের জন্যে কান্না জুড়ে দিলাম। আমার ভাতের সাথে আম-দুধ চাই-ই চাই।
অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, সেদিন ফেরি ঘাটে পাঁচ-ছয় বছরের শিশুটার জয় হয়েছিল। সে বিজয়ীর হাসি হেসে প্রিয় খাদ্য ভক্ষণ করেছিল। অন্য সবাই তখন মহা-বিরক্ত হলেও, আমার এই বিশেষ খাদ্য আমার বাবাই সেখানে এনে জড় করেছিলেন। সে জন্যে সময় লেগেছিল, বাড়তি ভোগান্তি হয়েছিল; কিন্তু তিনি সেটা করেছিলেন। একটা ছোট শিশুর ইচ্ছা বাস্তবায়িত হয়েছিল। একটা শিশু স্বপ্ন দেখতে শিখেছিল। অসম্ভবকে যে সম্ভব করা যায় সেটা জেনেছিল।
বাবারা আসলে এই রকমই। সন্তানের সাধ-আনন্দ পূরণেই তাদের আনন্দ। সে জন্যে ব্যয়, ত্যাগের হিসেব- নিকেশটা নিতান্তই গৌণ। বাবা হলো সন্তানদের র কাছে শক্তি আর সাহসের প্রতীক। তিনি কোনো অভিযোগ ছাড়াই পরিবারের মৌলিক অধিকার অন্ন, বস্ত্র, বাস স্থান নিশ্চিত করতে উদয়াস্ত শ্রম দিয়ে চলেন। বরং এর মধ্যে আছে তার চরম পাওয়ার এক নীরব আনন্দ। সিগমণ্ড ফ্রয়েড বলেছিলেন, I cannot think of any need in childhood as strong as the need for a father's protection. এটা বলাই বাহুল্য, বাবা ছোট বেলায় সন্তানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যে কোনো মূল্য দিতে প্রস্তুত থাকেন।
সন্তান বেড়ে উঠার পেছনে মায়ের সাথে সাথে সব চেয়ে বড় নেপথ্য ভূমিকা বাবাই পালন করেন। অনেকটা ছায়াছবির পরিচালকের মতো। দর্শক তাকে না দেখলেও, সিনেমা নির্মাণের সম্পূর্ণ দায়িত্ব তার ঘাড়ে। আমার বাবা তার কোন ব্যতিক্রম ছিলেন না। পরিবারের সবার সফলতা, আনন্দই তার যেনো সার্থকতা। বেশ তরুণ বয়স থেকেই বাবাকে বুঝতে চেষ্টা করতাম। বড় পরিবার আর সীমিত আয় ছিল। তাই নিজে নিজে ঠিক করেছিলাম, উচ্চ মাধ্যমিক পড়ার সময়ে কোন শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়ব না। অবশ্য আমরা সবাই জানি বাংলাদেশে প্রাইভেট না পড়লে, কত ধরণের বিড়ম্বনাই না হতে পারে। যাই হোক, বিষয়টা বাবা ঠিকই ধরতে পারলেন। আমাকে পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন, আমার কাজ হলো পড়া লেখা করা। আমি যাতে আমি সংসারের খরচ নিয়ে মাথা না ঘামাই। আমাদের যেটা প্রয়োজন, তা পূরণে তিনি বিন্দু মাত্র দ্বিধা করেন নি।
আমার লেখালেখির জীবনে সব চেয়ে বড় অনুপ্রেরণা দানকারী হলেন আমার বাবা। আমার প্রতিটা লেখা তিনি ক্লান্তি-হীনভাবে মহা-উৎসাহে পড়েন। আমার বই হাতে পেলে তিনি শুধু নিজে পড়েই ক্ষান্ত হন না, পরিচিত সবাইকে পড়তে দেন। লাইব্রেরীতে দিয়ে আসেন, সেখান থেকে যাতে অন্যরাও পড়তে পারে। সবার কাছে বুক ফুলিয়ে বলেন, তার ছেলে বই লিখে। কিন্তু আমি একেবারে পরিষ্কারভাবেই জানি, লেখালেখি করার ক্ষমতা আমি তার থেকেই পেয়েছি। আমি নিজেও তার মতো অনুভূতিগুলোকে যতটুকু না মুখে বলে প্রকাশ করতে পারি; তার থেকে অনেক বেশী স্বচ্ছন্দ-বোধ করি লিখে পাঁচ জনকে জানাতে। তিনি বিশ্বাস করেছিলেন, আমার সেই ছোট বেলা থেকে যে আমি লিখতে পারব। সেই জন্যে আমাকে উৎসাহ দেয়ার ব্যাপারে তার মধ্যে কোনো কমতি ছিল না। তবে আমার কাছে সব চেয়ে বড় বিষয় হলো, লিখতে হলে নিজের মধ্যে যে আস্থা থাকতে হয়, সেটা একান্তই তিনিই আমার মধ্যে তৈরি করে দিয়েছিলেন। “My father gave me the greatest gift anyone could give another person: he believed in me.” —Jim Valvano আমার জীবনে আমি সব চেয়ে বড় যে উপহারটা পেয়েছি, সেটা হলো: আমি যে পারবো, সেটা তিনি বিশ্বাস করেছিলেন।
আমার ভাতিজি অন্তু ঘোষণা করেছিল, দাদার মত কোন মানুষ না পেলে, সে বিয়েই করবে না। আমার বাবার; আমার মায়ের জন্যে ভালোবাসা একেবারে কিংবদন্তীর কাহিনীর সমতুল্য। প্রিয়তমাকে খুশী করার জন্যে যে কোন ধরণের কষ্ট করতে ছিল তার মহা আনন্দ। সেটা হউক না কেনো বেশ রাতে যখন ঘুমের প্রস্তুতি চলছে এবং পাড়ার দোকানগুলো বন্ধ হয়ে গেছে, তখন মায়ের জন্যে দূর কোথাও থেকে পান, কোক (coke) কিংবা কোনো ওষুধ কিনে আনা। এখানে বলে রাখি, আমার মায়ের মাঝে মাঝে রাতে খাওয়ার পরে পেটে অস্বস্তি হতো। তখন তার পান, কোক কিংবা কোনো ওষুধের দরকার হয়ে পড়ত। আমরা অধম সন্তানেরা মায়ের সেই অনুরোধ পালনে নিজের আরামের কথা চিন্তা করতাম। কিন্তু আমাদের বাবা ঠিকই বের হয়ে পড়তেন, আমাদের মায়ের জন্যে ঠিকই পান, কোক কিংবা কোনো ওষুধ নিয়ে ফিরতেন।
দিনের শেষে মাকে তার সারা দিনের উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলো বলা চাই। মাকে তিনি ডাকতেন ‘বেগম সাহেব’ আবার কখনো ‘ম্যাডাম’ বলে। বাসায় ঢুকে জানিয়ে দিতেন, ম্যাডাম আজকে একটা রগড় হয়েছে। তার পরে খেতে বসে বলতে থাকতেন সারাদিনের সব বৃত্তান্ত। একাত্তরের পাক হানাদারের বন্দিখানা থেকে আমার মাকে তিনি যে সব চিঠি লিখেছিলেন, তার মধ্যে আমার মা আর পুরো পরিবারের জন্যে, তার যে প্রচণ্ড ভালোবাসা আর উৎকণ্ঠা থাকতো। সেটা পড়লে কিংবা ভাবলে এখনও চোখ দুটো ভিজে আসে। আমার মা না ফেরার দেশে চলে গেছেন, তার পরেও সেই ভালোবাসা এক বিন্দুও কমেনি। মায়ের প্রিয় ফুল ছিল হাসনাহেনা আর শিউলি। তিনি মায়ের কবরে উপর লাগিয়ে দিয়েছেন এই দুই ফুলের গাছ। মায়ের মৃত্যুর সময়ে বাড়ির ফার্নিচারগুলো যে জায়গাগুলোতে ছিল, তিনি তার কোনোটারই স্থান পরিবর্তন করতে দেননি। এতোগুলো বছর পরেও মনে হতে পারে মা হয়তো কোথাও বেরাতে গেছেন, যে কোনো মুহূর্তে ফিরে আসবেন!
আমরা সাত ভাই। এখন তার পুত্র, পুত্র-বধূ, পৌত্র মিলিয়ে পরিবারের সদস্য সংখ্যা তিরিশ। তিনি সবাইকে প্রচণ্ড ভাবে, একেবারে সমান তালে ভালোবাসেন। পরিবারের বাইরে মানুষদের বিপদে-আপদে তিনি সবার আগে এগিয়ে যান। অনেক মানুষ তার এই উদারতার সুযোগ নিয়ে তাকে ভুগিয়েছে। বাবা তার মা হারিয়েছিলেন জন্মের কিছুদিন পরেই। অনেকটা আদর-ভালোবাসা-হীন জগতে তার বেড়ে উঠা। প্রায়ই ভাবি, এ রকম একজন মানুষের মধ্যে এতো ভালোবাসা এলো কি করে!
পৃথিবীর অন্য সব সন্তানের মতো, আমি কোন ভাবেই বাবার কাছে ঋণের এক অংশও শোধ করতে পারব না। কিন্তু হয়ত তাকে কোনো উপহার দিতে পারি। কিন্তু সেটা কি হতে পারে? আজকের এই লেখাটাই না হয় সে রকম একটা উপহার হয়ে থাকুক। আমি জানি তিনি এই লেখাটা পড়বেন; অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ ভেবে আকুল হবেন।
When a father gives to his son, both laugh; when a son gives to his father, both cry.---- Jewish Proverb ছোট বেলায় কোনো একটা খেলনা কিংবা কাজী আনোয়ার হোসেনের “কুয়াশা” সিরিজের সর্ব শেষ বই পেয়ে কত না খুশী হয়েছি। তখন শুধুমাত্র আমার খুশীর কারণে তার ভালো লাগার কোন সীমা-পরিসীমা থাকত না। আমি জানি, আমার আজকে এই উপহার পড়ে; বাবা আমার মতই কাঁদবেন: নীরবে, নিঃশব্দে এবং সবার অগোচরে।
পৃথিবীর প্রতিটি বাবাকে, আমার ফাদার্স ডের অগ্রিম অনেক অনেক শুভেচ্ছা। আমার মতে তারা প্রত্যেকেই একেক জন unsung hero। আর সেই যে বললাম, চলচ্চিত্র পরিচালকের মতো তারা নেপথ্যে থেকেই সব কিছুর আয়োজন করেন। তারা অফুরন্ত ভালোবাসা শুধু দিয়েই যান। স্বীকৃতি কিংবা প্রতিদান কোনোটাই কোনো ভাবে তারা আশা করেন না।
২. একজন বাবার কথা
আমার জানা নাই ‘বাবা দিবস’ এর জন্যে জুন মাসকে কেনো বেছে নেয়া হয়েছিল। তবে এই মাসের দিনগুলো বছরের অন্যান্য সময় থেকে দীর্ঘ। তার মানে এই সময়ে অন্ধকার থেকে আলোর পরিমাণ ঢের বেশী। সূর্য মনে হয় তার পুরো শক্তিটুকু দিয়ে অন্ধকার ঠেলে দূরে রাখে। এ বারের বাবা দিবসেও সন্তানেরা তাদের বাবাকে শুভেচ্ছা জানাবে, স্মৃতি রোমন্থন করবে, ফেসবুকে বন্ধুদের সাথে বাবার ছবি শেয়ার করবে কিংবা সম্ভব হলে বাবাকে উপহার পাঠাবে। এই বিশেষ দিবসে সন্তানদের সাথে সাথে বাবাদেরও কিছু বলার থাকতে পারে।
আমার একান্ত কাছের মানুষদের আমি আমার নিজের দেয়া নামে ডাকি। সেটা বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে শুধু আমি একাই এগুলো ব্যবহার করি। তাদের সাথে আমার একেবারে বিশেষ যে সম্পর্ক, তার থেকেই এ নামগুলো স্বতঃস্ফূর্তভাবে চলে এসেছে। এমন সু-বিশেষ মানুষগুলো হলো; আমার চার সন্তান এবং আমার প্রিয়তমা। সন্তান চার জনকে ভালোবেসে বুকের ঠিক বুকের মাঝ খান থেকে সম্বোধন করি: টুকু, কুটিম, শাট্টু আর কলজু নামে। শব্দ চারটার ভাষাগত দিক থেকে কোন অর্থ না থাকলেও; এগুলো আমার ভালোবাসা নিংড়ানো গভীরতম উচ্চারণ। প্রিয়তমার বিশেষ নামটা না হয় আজকে নাই-বা বলি। কখনও যদি তাকে নিয়ে কিছু বলার সুযোগ হয়, তখন না হয় সেখানেই সেটা জানাবো।
Disney’র এক বিখ্যাত মুভিতে জাফর নামে এক ভিলেন চরিত্র ছিল। সে আলাউদ্দিন ও অন্যান্যদের ভীষণ যন্ত্রণা করতো। কুটিম তখন একেবারে ছোট, বয়স পাঁচ-ছয়। তার প্রিয় চরিত্রগুলোকে ভিলেন এত কষ্ট দিচ্ছিল যে সে সেটা মেনে নিতে পারছিল না। ছোট মনের মধ্যে প্রতিকারের শত চিন্তা খেললেও কোনটাই তার পছন্দ মতো হচ্ছিল না। শেষে আমাকে বলল, “বাবা, তুমি ভিডিও টেপ (সেই সময়ে সিডি/ডিভিডি চালু হয়নি) থেকে জাফরকে টান দিয়ে বের করে দাও।” আমি সে সময়ে ওর অনুরোধের কাজটা করতে পারিনি। তবে এতটুকু বুঝতে পেরেছিলাম, আমাকে আমার সন্তান বিশ্বাস করছে, নির্ভর করতে পারছে। প্রয়োজনের মুহূর্তে সেটা যতই কঠিন বিষয় হউক না কেন; বাবাকে সে পাশে নিতে শিখছে। একজন বাবার কাছে এর থেকে বেশী গর্ব ও অহংকারের আর কি-ই বা হতে পারে?
কুটিমের আবাস আমার থেকে হাজার মাইল দূরে। সে যখন নিউ ইয়র্কে পড়ালেখার জন্যে যাচ্ছিল, তখন একটা কবিতা লিখেছিলাম। কবিতাটা সংক্ষেপ করলে অনেকটা এরকম হবে: “আমার মেয়ে এখন বড় হয়ে গেছে। সে এখন আর আমার কাছে থাকবে না। এইটা আমি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছি না। আমার বক্ষ-পিণ্ডকে এক হাজারটা পেপার পিন প্রতি রাতে রক্তাক্ত করছে।“ আজ সাত বছর হয়ে গেছে, পড়ালেখা শেষ করে সে এখন স্বপ্নের শহরে চাকরি করছে। কিন্তু আমার অন্তরটার রক্তাক্ত হওয়া বন্ধ হয়নি। জানি এর কোন শেষ নাই। এ যে বাবার হওয়ার ভীষণ কষ্টের একটা আনন্দ।
বড় মেয়ে টুকু। মনে হয় অল্প সময়ে অনেক বড় হয়ে গেল। তাকে বেশী দিন নিজের কাছে পেলাম না। এই তো সেই দিনই এতোটুকু ছিল! এখন সে নিজেই দু কন্যার ও এক পুত্রের মা। প্রায়ই মনে হয়, A wedding is for daughters and fathers. The mothers all dress up, trying to look like young women. But a wedding is for a father and daughter. They stop being married to each other on that day.” ― Sarah Ruhl, Eurydice আমার প্রিয় কন্যাটা আজ যোজন যোজন মাইল দূরে এমেরিকার পশ্চিমতম শহর সিয়াটলে থাকে। এখন আর মন চাইলেও কাছে যেয়ে দু চোখ ভরে দেখতে পারি না। পাশে বসে দু-দণ্ড কথা বলা হয় না। হয়ত সেও জানে না, তার জন্যে আমার হৃদয়ে ভালোবাসার ইমারত বিশাল থেকে বিশালতর হয়েই চলেছে!
আমার পুত্র শাট্টু তখন ছোট দু-তিন বছরের। এক ঈদের নামাজের পরে তাকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। এক ফটো সাংবাদিক এসে বললেন, তোমাদের ছবি তুলি। পরের দিন স্থানীয় পত্রিকায়, মার্কিন প্রেসিডেন্ট যতটুকু ছবি, তার থেকে বড় করে বাবা-ছেলের ছবি ছাপা হলো। ছেলেটা আমার মতোই স্বল্পভাষী। আমি জানি তারও সবার জন্যে বুক ভর্তি ভালোবাসা। আমি নিশ্চিত, সে এক দিন বিশাল বড় মানুষ হবে। তখন বুকটা আমার প্রস্থে দুই দিকের দুই দিগন্ত রেখা অনায়াসে স্পর্শ করবে।
ছোট সন্তান কলজু। সারাদিন অনর্গল কথা বলে চলে। স্বভাবে তার ভাইয়ের একেবারে বিপরীত। ভালোবাসা প্রকাশে কোন দ্বিধা নাই। পারলে দিনে সে এক শত বার এসে বাবা-মা কে আদর করে যায়, বলে যায় তার ভালোবাসার কথা। প্রায়ই ঘোষণা করে, তার বাবাই হল পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ।
আমার সৃষ্টি করা গল্পের চরিত্রগুলো আমার কাছে সন্তানদের মতোই প্রিয়। আমার “মেয়েটার নাম আকাশী” গল্পে আকাশীকে তার বাবা এভারেস্ট জয়ে উদ্বুদ্ধ করেছিল। আকাশীর পাহাড়ে উঠতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল, পা ভারী হয়ে আসছিল। কিন্তু তার পরেও সে এভারেস্টের চুড়ায় পৌঁছতে পেরেছিল। তার প্রতিটা পদক্ষেপ ছিল কষ্টকর; সমাজের একেকটা অন্যায়ের প্রতিবাদ। সে গুলো ছিল নারীদের উপর সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে হুঙ্কার। আকাশীকে বাবা একেবারে পরিষ্কারভাবে বুঝিয়েছিল যে মেয়েরা কখনোই কারোর থেকে কোন অংশেই কম না। মনোবল ও ইচ্ছা থাকলে মেয়েরা সেটা প্রমাণ করে দেখাতে পারে।
আমার প্রতিটা মুহূর্তের আশীর্বাদ সন্তানদের মঙ্গলের জন্য। জুন মাসের সূর্যের প্রখর আলোর মতো আমারও প্রতিটা মুহূর্তের চেষ্টা, সন্তানদের উপর থেকে অন্ধকার ও অমঙ্গলের কালো মেঘকে ঠেলে দূরে সরিয়ে রাখার। আমার সন্তানদের কারণেই আমি এক জন পিতা, এক জন বাবা হতে পেরেছি। সেটাই আমার জীবনের অন্যতম সেরা উপহার। কতো না মধুর সুরে সন্তানদের কাছ থেকে “বাবা" শব্দটা শুনি। “Blessed indeed is the man who hears many gentle voices call him father.” ― Lydia Maria Francis Child আমার চার সন্তানদের প্রত্যেককে অসংখ্য ধন্যবাদ। বাবা হতে না পারলে জীবনে অনেক বড় একটা অপূর্ণতা থেকে যেতো।
সাথে বিশালতম ধন্যবাদ আমার প্রিয়তমাকে। সে গর্ভ ধারণ করে সন্তানদের জন্ম দিয়েছিল বলেই আমি বাবা হতে পেরেছি।
এবং আমাকে এই অসামান্য ভাগ্যবান করার জন্যে পরম করুণাময় সৃষ্টিকর্তাকে অপরিসীম কৃতজ্ঞতা।