অভাবনীয় ক্যারিবিয় সাগরের কেচ্ছা
মানুষ একটা অদ্ভুত প্রাণী। কত কিছু না সে করে। পর্বত শৃঙ্গ জয় করে, মহাশূন্যে যায়, সাগরের তলায় নামে, সাঁতরে সমুদ্র পাড়ি দেয়। কেন এমন ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে? সুখ পায়, আনন্দ পায়, জয়ের নেশার পতাকা উড়াতে, তার বুঝি কোন ক্লান্তি নাই। কিছু মানুষ আবার উপার্জনের জন্যে দুঃসাহসিক কাজ বেছে নেয়। কেউবা মায়ামমতাহীন মরুভূমির দেশগুলোতে যেয়ে অমানুষিক পরিশ্রম করে। অনেকে দেশে থেকেই কঠিন ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে। বঙ্গোপসাগরে সাম্পান চালায়, বিপদ সঙ্কুল মাঝ দরিয়ায় যেয়ে মাছ শিকার করে।
এই দ্বিতীয় ধরণের মানুষদের কত শতাংশ কাজ উপভোগ করে, তা কিন্তু কঠিন প্রশ্ন। অনেকটা এমেরিকানদের কথায় ‘মিলিওন ডলার কোশ্চেন’ বা কোটি টাকার প্রশ্ন। তবে এ কথা আমরা বলতেই পারি, অল্প কিছু মানুষের সন্তুষ্টি থাকলেও; সিংহ ভাগ মানুষের কাজে অন্তর থাকে না, বলা যায় অনেকটা টাকা আয় করার জন্যেই এই সব কাজ করে। সুযোগ থাকলে অন্য কিছু করতো। তবে এরা মনের হতাশা মনের মধ্যেই লুকিয়ে রাখে। জীবিকার কথা ভেবে, অন্য কিছু মাথায় আসলে সেটা প্রশ্রয় দেয় না। প্রচণ্ড কাঁদতে ইচ্ছা করলেও কাঁদে না, মহা বিরক্তি আসলেও মুখে কিংবা ব্যবহারে প্রকাশ করে না। কিন্তু আপনারাই বলুন, ঘর-সংসার আর প্রিয় মুখদের ছেড়ে দূরে কোথাও যেয়ে কিংবা টাকার জন্যে বিপদ সংকুল, কষ্টের কোন কাজ করতে গেলে মুখে কি স্বতঃস্ফূর্তভাবে হাসি আসে? হাসি হাসি মুখ করলে, হাসির অন্তরালে এক কোণায় ঠিকই সূক্ষ্ম বিষাদ রেখা থাকে। তবে বেশীর ভাগ মানুষের চোখে সেটা ধরা পড়ে না।
পৃথিবীর সাত মহাদেশ ঘিরে আছে পাঁচ মহাসাগর। আর এই মহাসাগরগুলোতে এসে মিশেছে সাগর, উপ- সাগর। আবার নদী এসে মিশেছে উপসাগর, মহাসাগরে। এত সব পানি রাশির শাখা, প্রশাখা, উপশাখা হল পৃথিবীর শিরা-উপশিরার মত। অবশ্য শিরা-উপশিরা বললে কমই বলা হবে। কারণ পৃথিবীর চার ভাগের তিন ভাগ পানি। সে জন্যে পানিকের পৃথিবীর প্রাণ বললেই সম্ভবত সঠিক হবে। যাই হোক, গালফ অফ মেক্সিকো উপসাগর যেখানে ক্যারিবিয়ান সাগরের সাথে মিলেছে, সেখানকার এক ঘটনা বলি।
এমেরিকা, ইউরোপ ও অন্যান্য কিছু বিত্তশালী দেশ থেকে ছুটি কাটানোর এক বিশেষ ব্যবস্থা আছে। সেটা হল ক্রুস শিপ বা প্রমোদ তরীতে ভ্রমণ। তরীগুলো এক বন্দর থেকে ছেড়ে কয়েকদিন জল পথে ঘুরে আবার সেখানেই ফিরে আসে। মাঝে কয়েকটা বন্দরে বিরতি নেয়। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই সেগুলো হয় অন্য কোন দেশের কিংবা দূরের কোন বন্দর। বন্দরে নামলে আরেক ধরণের মানুষের সাথে পরিচিত হওয়া যায়। জানা যায়, তাদের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য। ক্রুস শিপ বা জাহাজের বর্ণনায় পরে আসছি। তবে, আপাতাত বলে রাখি, ক্রুস শিপকে বলা যেতে পারে, ভাসমান পাঁচ তারকা হোটেল। যাত্রী মানে অতিথিদের সেবায় সদা ব্যস্ত জাহাজের কর্মচারীরা।
এ রকম বিলাস বহুল জাহাজে বিশাল সংখ্যক কর্মচারী কাজ করে। আরেকটু ধারণা দেই। জাহাজে যাত্রী সংখ্যা তিন হাজার। শুনলাম যাত্রীদের সেবায় নিয়োজিত সত্তরটা দেশের এগারো শ কর্মচারী। হরেক ধরণের কাজ তাদেরঃ জাহাজ চালানো, রক্ষণাবেক্ষণ, পরিষ্কার-পরিচ্ছনতা, রান্না -বান্না, যাত্রীদের নাচ, গান, কৌতুক, যাদু পরিবেশ করা থেকে নানাভাবে বিনোদিত রাখা। কাজের কারণেই তাদের হাসি মুখ রাখতে হয়। ভালই লাগে হাসি মুখগুলো থেকে সেবা পেতে। কিন্তু অন্তদৃষ্টিতে এই হাসি বেশীক্ষণ রেখাপাত করে থাকে না। যাত্রীরা যেমন বিভিন্ন দেশের নানা বর্ণের, কর্মচারীরাও তেমন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসেছে। আর আমার এই বাঙালি চোখ খুঁজে বেড়াচ্ছিল এই শত মানুষের মধ্যে একটা বাঙালি চেহারা, কান শুনতে চাচ্ছিল বাংলা কথা। হতাশ হতে হল না, ঠিকই পেয়ে গেলাম বাঙালি।
জাহাজের এক কোণায় যাত্রীদের ফরমায়েশ অনুযায়ী স্যাণ্ডউইচ বানাচ্ছিল, ১৮- ১৯ বছরের এক ছেলে। পরনে সাদা বাবুর্চিদের পোশাক। উজ্জ্বল বর্ণ। ল্যাটিন এমেরিকা, ভারত, থেকে আরম্ভ করে অনেক দেশের মানুষেরই এ রকম বর্ণের হতে পারে। তবে একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য আমার চোখ কাড়লো। তার মুখে এ গাল থেকে ও গাল পর্যন্ত চিরস্থায়ীভাবে হাসি লেগে আছে। অন্যদের মত শুধু ঠোঁট সম্প্রসারিত করা মুচকি হাসি না; একেবারে নির্ভেজাল মন ভাল করা হাসি।
ও রকম হাসি নেহায়েত সংক্রামক-ই না, এইটা আবার কাছে টানে। প্রয়োজন ছিল না, তার পরে লাইনে দাঁড়ালাম। ছেলেটা সম্পর্কে কৌতুহল না মিটিয়ে যেতে ইচ্ছে করছিল না। সুযোগ আসতেই ইংরেজিতে জানতে চাইলাম, সে কোন দেশের মানুষ। মিষ্টি করে উত্তর দিল ভারত। আরও উৎসাহ নিয়ে প্রশ্ন করলাম, ভারতের কোন প্রদেশের। আবার এক গাল হাসি হাসি মুখ করে অনেক আগ্রহ নিয়ে উত্তর দিল বেঙ্গল। মানে পশ্চিম বঙ্গ।
বঙ্গের মানুষ মানে বাঙালি। নিশ্চয়ই বাংলায় কথা বলে। কিন্তু মনে একটু খটকা লাগলো। দেখতে উজ্জ্বলবর্ণ। যদি বাঙালি না হয়! কিংবা তার ভাষা বাংলা না হয়ে থাকে। অন্য ভাষী মানুষরাও এখন পশ্চিম বঙ্গে থাকে। বেশ কিছু মানুষ পশ্চিম বঙ্গ থেকে এসেও বাংলা ঠিক পারে না; তার নজির আগে বেশ কয়েক বার পেয়েছি। ছেলেটিকে বললাম, “তুমি কি বাংলা পারো?” আমাকে বেশ অবাক করে খাঁটি বাংলা ভাষায় উত্তর দিল, “জী, আমি তো বাঙালি। আপনারাও নিশ্চয়ই বাঙালি।” সাথে আমার স্ত্রী ছিল, সম্পর্কটা সে সহজেই আন্দাজ করে নিয়েছে।
মধু। মনে হল কানে কেউ বুঝি কানে মধু ঢেলে দিল। ক্যারিবিয়ান সাগরের আন্তর্জাতিক সীমানায় এমন সুন্দর অভিজ্ঞতা হওয়াতে ভীষণ বিস্মিত হলাম। বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে, অন্য বর্ণের হাজার মানুষের মাঝে এক জন বাঙালি খুঁজে পাওয়া; সাথে বাংলা ভাষা শুনতে পাওয়া যে কি প্রচণ্ড আনন্দের, তা বাঙালি মাত্রই একটু ভাবলেই বুঝতে পারবেন।
সারাক্ষণ হাসি মুখ নিয়ে যাত্রীদের যে একের পর এক স্যাণ্ডউইচ বানিয়ে দিচ্ছে, তার নাম ইকবাল। জাহাজে চাকরি নিয়ে এসেছে। পশ্চিম বঙ্গের কোন এক গ্রামে তার বাড়ি। বাড়িতে মা আছে, বাবা আছে। বড় দিদির বিয়ে হয়ে গেছে। ছোট একটা বোন স্কুলে যায়। মা মাত্র ছয় মাস আগে কান্নার এক সাগর বানিয়ে ইকবালকে বিদায় জানিয়েছিলেন। বাবার স্বল্প আয়ে চলতে কষ্ট হয়, অভাবের সংসার, তাই হয়ত ইকবালকে বিদেশ-বিভুয়ে সাগরের উপরে কাজ করতে দিতে রাজী হয়েছিলেন।
ইকবালের শরীরটা কাজের জন্যে সাত সমুদ্র পাড়ি দিলেও, মনটা সুযোগ পেলেই চলে যায় সেই গ্রামের বাড়িতে, মায়ের কাছে। সাগরের পানির মত মনটা উথাল পাথাল করলেও, মন ভোলানো হাসি কিন্তু স্বতঃস্ফূর্তভাবেই লেগেই আছে।
কিন্তু ইকবালের এই প্রাণবন্ত হাসির রহস্য? আমরা কি চেষ্টা করলে তার মত হাসি সারাক্ষণ ধারণ করে থাকতে পারি?
২
বিয়ে করেছিলাম কবে? এইতো মনে হয় সেইদিন। একবারে নতুন কড়কড়ে প্রেমের গন্ধ সব সময়ই পাই। ফুল বাসী হলে শুকোতে থাকে; গন্ধ হারাতে থাকে। কিন্তু কি অদ্ভুত? আমাদের মানে আমি ও আমার সহধর্মিণীর প্রেম নামের যেই ফুল আছে, দিন গড়ানোর সাথে আরও বেশী সজীব হচ্ছে। চারিদিকে সুবাসে, অস্থিরতার মাদকতা বেড়েই চলেছে। যদিও ক্যালেন্ডারের হিসেবে দাম্পত্য প্রেমের ২৭ বছর পার হয়ে গেল, তার পরেও আমাদের রোমান্স বেড়ে চলেছে পৌনঃপুনিক গতিতে।
প্রতি বার বিবাহ বার্ষিকীর বিশেষ দিনটা অন্য রকমভাবে উদযাপন করার চেষ্টা থাকে। সুন্দর কোন জায়গা ভ্রমণ বেশীর ভাগ সময়ে এই উদযাপনের অংশ হয়। প্রথমে সে রকম পরিকল্পনা চলছিল। কিন্তু হঠাৎ মাথায় এলো জাহাজে করে সমুদ্র বিহারে গেলে কেমন হয়? দেশে-বিদেশে মেলা ঘুরা ফেরা হয়েছে, কিন্তু যাত্রী জাহাজে করে এক দেশ থেকে আরেক দেশে যাওয়া হয় নি। যেই ভাবা সেই কাজ। সমুদ্র ভ্রমণ নিয়ে গবেষণা আরম্ভ করে দিলাম। ভাগ্যটা সু-প্রসন্ন বলতে হবে, নাগালের মধ্যে দামে টিকেট পেয়ে গেলাম। দেরি করলাম না, চট করে কিনেই ফেললাম। যা আছে কপালে। সমুদ্রের উপর থেকে সীমাহীন সমুদ্রের পানি দেখব, দিগন্তের আকাশ, চাঁদ, সূর্যের উদয়, অস্ত দেখব, আকাশ ভরা তারা দেখব; ভাবতেই মনটা ভীষণ রোমাঞ্চিত হয়ে উঠলো। তাও আবার শুধু দু-জনে।
আমাদের বর্তমান আবাস হল এমেরিকার টেক্সাসের ডালাস শহরে। নিকটতম বন্দর হল হিউস্টন ছাড়িয়ে গ্যালভ্যাস্টন। ফেব্রুয়ারির ১৪ তারিখ শনিবার দুপুর দুটোর মধ্যে জাহাজে উঠতে হবে। সময়মত বন্দরে পৌঁছে গেলাম। নোঙ্গরে আমাদের জাহাজ কার্নিভাল ক্রুস লাইনের- ‘ট্রায়াম্প’। প্রথম দৃষ্টিতে মন কেড়ে নিল। রঙ্গিন এক শহর দাঁড়িয়ে আছে মনে হল। জাহাজের ছাদে ডলফিন মাছের মত বিশাল লেজের দুটো ভাগ ; একটা দিক কালো ও অন্যটা লাল। মাছের লেজ শরীরের উপরে থাকে না; তার পরেও জাহাজ নির্মাতাদের নান্দনিক রুচিতে মুগ্ধ হলাম। একেবারে তর সহ্য হচ্ছিল না। দৌড়ে ঢুকতে ইচ্ছা করছিল। কিন্তু চাইলেই তো আর হল না। যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে মেক্সিকো ঘুরে আসবে জাহাজ, আমাদের ইমিগ্রেশান লাইনে দাঁড়াতে হল। অনেকটা আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের মত অবস্থা।
জাহাজের ভিতরে ঢুকে মনেই হল না, আমরা পানির উপরে ভাসছি। পাঁচ তারকা হোটেলের লবিতে মনে হল পৌঁছে গেছি। সেখান থেকে লিফটে করে নয় তালা। সেখানেই আমাদের অস্থায়ী থাকার জায়গা মানে ক্যাবিন। ছোট জায়গার মধ্যে চমৎকার আয়োজন। বড় একটা বিছানা, সোফা, পড়ার টেবিল, ড্রেসিং টেবিল। সাথে লাগোয়া বাথরুম। আর আসল চমকটা বলাই হয় নি। ক্যাবিনের বিশাল জানালার পাশে একটা দরজা আছে। সেটা দিয়ে বের হলে ছোট চিলতে এক বারান্দা বা ব্যাল্কনিতে দুটো চেয়ার পাতা। বারান্দা থেকেই সব দেখা যাবে, যা যা মনে মনে প্ল্যান করে এসেছি। কষ্ট করে জাহাজের ডেকে যাবার দরকার হবে না, কিংবা জানালা দিয়ে উকি দিয়ে বাইরেটা দেখতে হবে না। হৃদয়টা এক লাফে নেচে উঠলো, “হৃদয় আমার নাচেরে, ময়ূরের মত নাচেরে।”
খুব একটা উচ্ছ্বাস প্রকাশের সময় পেলাম না। ইনটারকমে ঘোষণা এলো, জাহাজের পাটাতনে প্রত্যেককে বাধ্যতামুলকভাবে সমবেত হতে, বিপদকালিন সময়ে কি করতে হবে, তার উপর সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ। আগুন এবং পানিকে না-কি মেনে চলতে হয়। একটু এদিক ওদিক হলেই মহাবিপদ ছুটে আসে। মিয়া, বিবি দু জনে নিচে নেমে গেলাম।
জাহাজের সব যাত্রী ও নাবিকরা সেখানে সমবেত হয়েছে। নানা দেশ থেকে যেমন যাত্রীরা এসেছে, ঠিক নাবিকরাও পৃথিবীর নানা প্রান্তের। নাবিকরা তাদের সাদা পোশাক পরেছে। প্রত্যেকের বুকে নেম ট্যাগ সাটানো। সেখানে তাদের নামের সাথে ব্র্যাকেটে নিজ নিজ দেশের নাম লেখা আছে। তবে সবাই ইংলিশ বলতে পারে। আমাদের জানিয়ে দেয়া হল, জাহাজ যদি কোন দুর্ঘটনায় পড়ে এবং পানি ঢুকা আরম্ভ করে, তা হলে কি করে লাইফ বোটে উঠতে হবে। মুহূর্তে টাইটানিকের কথা মনে পড়ে গেল। না সে রকম হবে না, এখন কত না আধুনিক প্রযুক্তি। হয়ত টাইটানিকের যাত্রীরাই একই কথা ভেবেছিল।
জাহজের কোথায় কি জানার জন্যে ছোট একটা সফর করলাম। ১১ তলা জাহাজ। ১০ তলার অর্ধেকটা জুড়ে খাবার দাবারের জায়গা। বাকী অর্ধেকটায় উন্মুক্ত থিয়েটার। সেখানে ছায়াছবি দেখার ব্যবস্থা। বিশাল বড় পর্দায় একের পর এক ছবি দেখাচ্ছে। দুটো সুইমিংপুলও আছে। চাইলে পুলের পানির মধ্যে দাঁড়িয়ে কিংবা বসে, বসে বড় পর্দার দিকে তাকিয়ে থাকা যায়। যাদের বয়স ১৮’র বেশী, তারা অনায়াসে এলকোহল পান করতে করতে উপভোগ করতে পারে। সব চেয়ে মজার ব্যাপার হল, জাহাজে এলকোহল ছাড়া সব কিছুই ফ্রি মানে বাড়তি কোন দাম দিতে হবে না। নৌ বিহারের দামের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত।
থাকা ও খাবার জায়গা চেনা হয়ে গেল। বেশ স্বস্থি লাগল। বাকী জায়গাগুলো না হয় এক এক করে জেনে নিব। ফিরে এলাম ক্যাবিনে। দু জনে মিলে কাপড়-চোপড় স্যুটকেস থেকে বের করে আলমারিতে সাজিয়ে রাখলাম। পাঁচ দিনের থাকার জন্যে জিনিস পত্র নেহায়েত কম লাগে না। কাজ শেষ করতে না করতেই, কাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত এসে উপস্থিত হল। বিকাল চারটা বাজতে আর মাত্র কয়েক মিনিট বাকী, তার মানে যাত্রা শুরু হবে। আমারা ব্যাল্কনিতে যেয়ে দাঁড়ালাম। অতিকায় জাহাজটা নড়া আরম্ভ করল। ধীরে ধীরে বন্দর ছেড়ে আমরা এগুতে আরম্ভ করলাম।
৩
ক্রুস শিপে প্রথম দিনের প্রথম রাত। প্রিয়তমা জানতে চেয়েছিল, জাহাজের সময়গুলো কেমন করে কাটাতে চাই। তখন কিছুটা সংকোচ নিয়ে জানিয়েছিলাম, যেহেতু বিবাহ-বার্ষিকী উদযাপন, তা হলে বিয়ের পরের সময়গুলো ফিরে পেলে মহা আনন্দিত হতাম। কিন্তু তাই কি সম্ভব? যে দিন গেছে সে দিন কি ফিরে আসে? আমার যুক্তি ছিল, চেষ্টা করতে তো আর দোষ নাই।
রাতে খাবার খেয়ে আসার পরে আমার প্রিয়া বলল, যাও “বাইরের থেকে একটু ঘুরে এসো।” বুঝলাম সে হয়ত কিছু একটা করার প্রস্তুতি নিবে। কম্পিউটারটা সাথে নিয়ে ক্যাবিন থেকে বের হয়ে পড়লাম। চার তলায় এক জায়গায় দেখেছি লেখা ‘লাইব্রেরারি’। ভাবলাম ওখানে ঘণ্টা খানেক কাটিয়ে আসি। যেয়ে দেখলাম, বুক শেল্ফে অল্প কিছু বই ও ম্যাগাজিন সাজানো। তবে আমি-ই হলাম একমাত্র পাঠক। সেগুলো নেড়ে চেড়ে দেখলাম। কোনটাই তেমন আগ্রহ জন্ম দিতে পারলো না। এর মধ্যে এক দম্পতি ঢুকলো। ওদের সাথে হাসি বিনিময় হল। দেখি দাবার বোর্ড খুলে গুটি সাজাচ্ছে। দাবার জগতে নিমিষেই হারিয়ে গেল।
আমার কম্পিউটার অন করলাম। এই একটা জিনিষ, হাতে পেলে আমি আর কিছু চাই না। কি যেন কবিতার লাইনটা, “সুরা নাই , পাত্র হাতে কাঁপিতেছে সাকী”। না, আমার সুরা, সাকীর --কোনটারই কখনও প্রয়োজন হয় না। পৃথিবীতে কত কিছু জানার আছে, দেখার আছে, কত না আনন্দে আত্মহারা হওয়ার উপাদান আছে। সেখানে কি-না কিছু তরল পানীয় দিয়ে নিজের ভিতরে বুদ হয়ে থাকা, না সেটা আমার কর্ম না।
কিভাবে যে দেড়-ঘণ্টা পার হয়ে গেছে, বুঝতেই পারি নি। প্রিয়তমা সময় চেয়েছিল ঘণ্টা খানেক, আর আমি কিনা এতক্ষণ লাগিয়ে দিলাম। ছুটে ফিরে আসলাম। দরজা খুলে ভিতরে ঢুকতেই অবাক হলাম। একেবারে কম বাতি। ধীর লয়ে মৃদু বাজনা বাজছে। রোমাঞ্চের সম্ভাবনা উকি দিল। বিছানার উপরে বউ সেজে বসে আছে আমারই হৃদয়-ঈশ্বরী। ঠিক একই রকম, যেমন সেই ২৭ বছর আগে পেয়েছিলাম। লাল রঙের শাড়ি, কপালে সূর্যের সমান টিপ, টকটকে লাল ঠোঁট। একেবারে আমার মনে যা ছিল, ঠিক তাই। মেয়েটা যে কেমন করে আমার মনের কথা বুঝে ফেলে! সেজন্যেই নিশ্চয়ই আমি তাকে, “ভালবাসিয়াছি, শত রূপে, শত বার”।
পরের দিন ঘুম থেকে উঠতে উঠতে বেশ দেরি হয়ে গেল। সূর্য মামা তার পূর্ণ আলো সাগরের উপরে ছড়িয়ে দিয়েছে। পর্দা সরাতেই জানালা দিয়ে অনন্ত নীল আকাশের সাথে সীমাহীন সমুদ্রের পানি দেখতে পেলাম। বন্দরে যেমন ঘোলাটে পানি ছিল, এখন সেরকম আর নাই। ভাল করে দেখার জন্যে দুজনেই ব্যাল্কনিতে ছুটে গেলাম। জাহাজের কাছের পানি হাল্কা নীল। দৃষ্টি যত দূরে দেই, পানির রং তত গাঢ় নীল। দিগন্ত রেখা যেয়ে মিলেছে আকাশে। সেটা আবার আরেক ধরণের হালকা নীল। নীল রং এমনিতেই অধীর করে তুলে, তার পরে এত নীলের সমাহার। চারিদিকে শুধু পানি আর পানি। আমাদের জাহাজ ছাড়া আশে পাশে আর কিছু দেখা যাচ্ছে না। বিধাতার সীমাহীন শৈল্পিক স্বাদে একেবারে মহা-বিস্মিত হয়ে রইলাম।
দিনটা ১৪ ফেব্রুয়ারি রোববার। প্রেমিক যুগলদের বিশেষ দিন, ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’। অনেকটা এই কারণেই জাহাজে আসন ক্ষমতার পুরোটাই বিক্রি হয়ে গেছে। ইদানীং ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে জিকা রোগের আধিক্যের জন্যে, মানুষ ওই দিকে যেতে চায় না। আরেকবার প্রমাণ হল ভালোবাসার কাছে অসুখ বিসুখের আশঙ্কা কোন ব্যাপারই না। শুনলাম আজকে জাহাজে ৯২ টা দম্পতি মালা বদল করবে। ভ্যালেন্টাইন ডে’ তে সাগরের বুকে, নীল আকাশের নিচে, ঢেউয়ের প্রাকৃতিক সিম্ফনিকে ব্যাক গ্রাউন্ডে নিয়ে সারা জীবনের সাথী করে নেয়ার প্রতিজ্ঞা করার যেয়ে বেশী রোমান্টিক আর কি হতে পারে! নিজেদের বিয়ে সময়ের হিসেবে হয়েছে সেই কবে, তারপরেও এতগুলো নব দম্পতিদের মাঝে, নতুনের জোয়ারের উচ্ছ্বাসে নিজেদের ভালোবাসা যেন আরও অনেক পোক্ত হয়ে গেল।
ডাইনিং এরিয়ায় গেলাম সকালের নাশতা সেরে ফেলতে। একই জায়গাকে বিকালের পর থেকে ডিনারের জন্যে রূপান্তর করা হয়। প্রায় গোটা পাঁচেক কাউন্টার। একেক জায়গায় একের ধরণের খাবার। কিছু কাউণ্টারে আবার অর্ডার দেয়া মাত্র অথিতির সামনেই ভেজে দেয়া হচ্ছে। বিভিন্ন ধরণের খাবারের সাথে হরেক রকমের ফলের সমাহার। প্রতিটা খাবার-ই মনে হল পৃথিবীর সেরা। স্বাদে, রসে একেবারে তুলনাহীন। শুনলাম সেরা বাবুর্চিদের এরা নিয়ে আসে। টসটসে ফলগুলোর জন্যে নির্দিষ্ট বাগান আছে। তার পরে তো আছে, জাহাজে তাজা রাখার প্রশ্ন। এমন কিছু পাওয়া গেল না, যেটা পচে যাচ্ছে কিংবা স্বাদে পূর্ণ রসালো না। অবাক হলাম সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায়।
নাশতা সেরে আমরা জাহাজের ডেকে উঠে গেলাম। সেখানে হাঁটার জন্যে “ওয়াকিং ট্রেলের” ব্যবস্থা। দু জনে হাঁটা আরম্ভ করলাম। সাগরের গর্জন বেশ ভালোই শুনা যাচ্ছিল, সাথে বাতাস। আমাদের টুপি মাথার উপরে রাখাটা কঠিন হয়ে দাঁড়ালো। আমি হাত দিয়ে টুপিটা ধরে রাখলাম। কিন্তু বেচারি প্রিয়তমা মনে হয়, একটু বেখেয়াল হয়েছিল। আর যায় কই, টুপিটা গেল উড়ে। কিছুক্ষণ হাসাহাসি চললো। সমুদ্রের কি টুপি পড়তে ইচ্ছা করতে পারে না!
সন্ধ্যায় এলাম জাহাজের অডিটোরিয়ামে। সেখানে এক বিচিত্রানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। নাম “বিশ্ব সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান”। হাজার খানেক লোক বসতে পারে। একেবারে অত্যাধুনিক স্টেজ। স্টেজে সামনের অর্কেস্ট্রা দলের বসার জায়গাটা ভিতরে ঢুকে । অনেকটা পাতালে চলে যাবার মত। মনেই হল না, ডাঙ্গায় না; আমার সাগরের পানির উপরে ভাসছি। স্টেজে আলো, ছায়া, থ্রি ডি ও সর্বশেষ প্রযুক্তির অদ্ভুত খেলা আরম্ভ হয়ে গেল। নাচে, গানে, অর্কেস্ট্রার মূর্ছনায় পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের ব্যাক গ্রাউণ্ডে তুলে আনল সেখানকার সংস্কৃতি। একটা বিশেষ পরিবেশনা মন কেড়ে নিল।
এমেরিকার লুসিয়ানা অঙ্গ রাজ্যে নিউ অরলিয়ান্স শহর। সেখানেও ফেব্রুয়ারি মাসে ‘মারডি গ্রা’ নামে বিশাল মেলা বসে। হাজার হাজার মানুষ যায় সেখানে। রং বেরঙের পোশাক পড়া মানুষদের প্যারেড হয়। ইউরোপিয়ান ধাঁচের সব সাংস্কৃতিক পরিবেশনা থাকে। মুহূর্তের মধ্যেই মঞ্চে নিউ অরলিয়ান্সের বিখ্যাত বরবন স্ট্রীট তেরি হয়ে গেল। মারডি গ্রা’র প্যারেড, মেলা, রেস্টুরেন্টে খাওয়া, নাচ, গান, আনন্দ দেখা হল। নিজেদের মনে হচ্ছিল, কোন ফাঁকে আমরাও যেন মেলায় হাজির হয়ে গেছি।
লুসিয়ানা এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গ রাজ্য হলেও, এক সময় জায়গাটা উপনিবেশিক ফ্রান্সের দখলে ছিল। ১৮০২ সালে যুক্তরাষ্ট্র তাদের থেকে ৮২৮,০০০,০০০ বর্গ মাইল জায়গা কিনে নেয়। প্রতি বর্গ মাইলের জন্যে খরচ পড়েছিল এক পেনি (১০০ পেনি= ১ ডলার)। এই জমি কেনার ফলে সেই সময়কার নবীন রাষ্ট্র আয়তনে দ্বিগুণ হয়েছিল। এই বিক্রির ফলে ফরাসি ভাষী যারা লুইসিয়ানায় থাকতো, তারা সবাই যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হয়েছিল। এদের বংশধররা এখনও ফ্রেঞ্চ ভাষায় কথা বলে। এবং বলার অপেক্ষা রাখে না তারা পূর্ব পুরুষের ঐতিহ্য শুধু ধরেই রাখে নি, ব্যাপক জনপ্রিয় করেছে।
কিভাবে যে দু ঘণ্টা চলে গেল বুঝতেই পারলাম না। একেবারে একটানা অনুষ্ঠান। সেট বদলানোর জন্যে কোন বিরক্তিকর বিরতি ছিল না। আমাদের যারা মঞ্চে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করেন, তারা থ্রি ডি ও অন্যান্য আধুনিকে প্রযুক্তি ব্যবহারের বিষয়টা ভেবে দেখতে পারেন। এতে খরচ কম পড়ার সাথে সাথে অনুষ্ঠানের আকর্ষণীয়তা অনেক গুণ বেড়ে যাবে। ঘরমুখী মানুষদের সংস্কৃতি চর্চা ও পৃষ্ঠপোষকতায় ফিরিয়ে আনা যে খুব দরকার। না হলে স্বাধীনতার অর্থই ব্যর্থ হতে চলেছে। অনুষ্ঠান শেষে রাতের খাওয়ার জন্যে উপরে উঠে গেলাম।
আবার সেই শত আইটেমের রাতের খাবার। পরিষ্কার, ঝকঝকে জায়গায় মিষ্টি হাসির মানুষগুলো খাবার পরিবেশনের দায়িত্বে। দু জনে প্লেট ভরে খাবার নিয়ে বসলাম। ছোট পেটে আর কত আটে? কিন্তু প্রতিটা আইটেম এত সুস্বাদু, যে ছেড়ে উঠতে মন চাচ্ছিল না। তার পরে যত ইচ্ছা তত খাও। শেষে অনেকটা রণে ভঙ্গ দেয়ার অবস্থা। বেশ কিছু খাবার উদর আর নিতে পারল না। দুঃখজনক হলেও, খেয়াল করলাম প্রায় প্রতিটা টেবিলেই অনেক উচ্ছিষ্ট হচ্ছে। সুস্বাদু স্বাদের খাবারের এক বড় অংশের এই অবস্থা দেখে, আমাদের মত গরিব দেশের মানুষের কষ্ট পাওয়াটাই স্বাভাবিক। আমাদের দেশে কত মানুষই না অর্ধ পেট আহার করে; অপুষ্টির কারণে কত না অসুখ বিসুখে ভুগে।
খাবার শেষ করে এলাম চার তলায়। সেখানে বড় একটা জায়গা জুড়ে ক্যাসিনোর বিভিন্ন মেশিনে জুয়া খেলার ব্যবস্থা। অনেক যাত্রীদের দেখলাম বড় টাকা জেতার আশায় মেশিনে টাকা ঢুকিয়ে চলেছে। গোটা কয়েক ‘বার’ দেখলাম। প্রাপ্ত বয়স্করা সেখান বসে মদ পান করছে। উচ্চ স্বরে সঙ্গীতের সাথে কেউ কেউ নাচছিল। আরও কয়েক জায়গায় দেখলাম শিল্পীরা রক, ল্যাটিন, কান্ট্রি মিউজিক করছে। কেউ গানের তালে নাচছে, আবার কেউবা কান পেতে মন দিয়ে গান শুনছে। কয়েক জায়গায় দেখলাম যাত্রীরা লাইন করে দাঁড়িয়ে একের পর এক পোর্টেট ছবি তুলছে। আমারা দু জনেও সেখানে ছবি তুলার জন্য দাঁড়িয়ে পড়লাম।
ফিরে এলাম ক্যাবিনে। কিন্তু দেখি দরজা খুলছে না। কয়েকবার চেষ্টা করেও পারলাম না। তার পরে আরেক রুমের দরজা খোলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলাম। বুঝতে পারলাম আমরা ভুল দরজায় চেষ্টা করছি। দু জনে চেষ্টা করেও নিজেদের ক্যাবিন নম্বর মনে করতে পারলাম না। হঠার, নিজেদের কর্মকাণ্ডে দু জনেরই খুব হাসি লাগলো। হাসি থামিয়ে যে রুম নম্বর মনে করার চেষ্টা করব, সেটাও মাথার মধ্যে খেলল না। বরং শব্দ করে হাসতেই থাকলাম। ভাগ্যটা অনেক ভাল যে আমাদের এই কর্মকাণ্ড অন্য কেউ দেখে নি। দেখলে কি না ভেবে বসত !
মানুষ নাকি বিশেষ অবস্থায় পৌঁছে গেলে, বুদ্ধি লোপ পায় ও হাসতে থাকে। কিন্তু আমাদের বুদ হওয়ার কোন কারণ থাকতে পারে না। না কি আমরা তাই হয়েছিলাম?
৪
পরের দিন সোমবার। জাহাজ নোঙ্গর করল মেক্সিকোর প্রগ্রেসো (Progresso) বন্দরে। চাইলে যাত্রীরা ছোট বন্দর নগরী দেখে আসতে পারে। সকাল আটটায় নোঙ্গর করেছে, আবার বিকাল চারটায় ছাড়বে। সুযোগটা লুফে নিলাম। আমাদের দু জনেরই নতুন জায়গা, নতুন মানুষ দেখার মধ্যে অনেক আনন্দ। নাস্তা সেরে জাহাজ থেকে বের হয়ে পড়লাম। প্রথমেই চোখে পড়ল, সারি সারি ডিউটি ফ্রি শপ। বাঙালিদের কোথাও গেলে সবার আগে উপহার কিনতে হয় প্রিয়জনদের জন্যে। কিছু কেনাকাটির চেষ্টা করলাম। দাম বেশীই মনে হল। পর্যটকদের জায়গা। দাম বেশী হওয়াটা স্বাভাবিক। লোক জন মেক্সিকোতে তৈরি জিনিস পত্র ও সুভেনিয়ারের বেশী নেড়ে চেড়ে দেখছিল। চীনের তৈরী সমগ্রিতেই এখানকার বাজার সয়লাব হয়ে আছে।
ডিউটি ফ্রি মার্কেটর পাশ থেকেই থেকেই শহরে যাবার জন্যে ফ্রি বাসের ব্যবস্থা। অন্য পর্যটকদের সাথে আমরাও বাসে উঠে পড়লাম প্রোগ্রেসো শহরের মূল জায়গাটা দেখে আসার জন্যে। বাস থেকে নেমে পায়ে হেটে রাস্তা পার হলাম। অনেকদিন পরে একটা বিরল দৃশ্য দেখলাম। ঠিক বাংলাদেশের মত রাস্তার মাঝে দাড়িয়ে পুলিশ হাত নেড়ে ট্রাফিক কন্ট্রোল করছে। হাত উঠালে থামো, হাত নামালে যাও। যুক্তরাষ্ট্র, কেনাডায় সব খানেই ট্রাফিক লাইট, কিংবা নিয়ম অনুযায়ী গাড়ি চলে। ব্যতিক্রম যে হয় না; সেটা বলা যাবে না। অবশ্য পুলিশ ধড়তে পারলেই টিকেট মানে জরিমানা গুণতে হয়। তবে অধিকাংশ নাগরিক নিয়ম মেনে চলে। পুলিশকে সারাক্ষণ তদারক করার দরকার পড়ে না।
মনে হল সত্তর-আশির দশকের ঢাকার কিয়দংশ খুঁজে পেলাম। গায়ে লাগানো একের পর এক বিল্ডিং। বেশ বয়স হবে। পুরনো ঢাকার বিল্ডিঙগুলোর মত। বিভিন্ন ধরণের ছোট ছোট দোকানপাট। মুদির দোকান, কনফেকশনারি, ওষুধের দোকান, কাপড়ের দোকান। জিনিসপত্রের দাম লেখা থাকলেও, দর কষাকষি হচ্ছে। বেশ মানুষের ভিড়। পায়ে হেটে চলেছে। ফুটপাথে ঠাসা মানুষ। পথে ঘাটে ময়লা, বেশ নোংরা মনে হল। তবে ঢাকার থেকে পরিষ্কার। ভিক্ষুক দেখলাম। তারা মানুষের কাছ থেকে পয়সা নিচ্ছে। কিছু পথচারী পেসো (মেক্সিকোর অর্থ) ছুঁড়ে ভিক্ষা দিচ্ছে।
আমাদের এক ফকিরকে দেখে মায়া হল। প্রতিবন্ধী ফকিরের হাত বাঁকা, অনেকটা আমাদের দেশের ফুটপাথে বসা ভিক্ষুকদের সাথে মিলে গেল। পকেটে ডলার ছিল, তাই দিয়ে দিলাম। বিদেশী টাকা চিনতে তার অসুবিধা হল না। সে নিজের জায়গা থেকে উঠে এসে আমার সাথে হাত মিলিয়ে জড়িয়ে(hug) ধরে কৃতজ্ঞতা জানালো। বুঝলাম, এদের শ্রেণী বিভেদ জ্ঞান হয়ত বাংলাদেশের থেকে কম। আমাদের দেশে এক জন ভিক্ষুক দানকারীর সাথে হাত মিলাতে যায় না। সে হয়ত ধরেই নেয় তার গোত্র দানকারীর থেকে নিম্ন। মনে প্রশ্ন আসছিল, মেক্সিকো, যুক্তরাষ্ট্র প্রতিবেশী দুটো দেশ। কিন্তু জীবন যাত্রার মানের কত না পার্থক্য!
এখন না হয় শহরটা সম্পর্কে কিছু বলি। ২০১০ সালে এই বন্দর নগরীর অধিবাসীর সংখ্যা ছিল ৩৭,৩৬৯। ওই অঞ্চলের মাছ ও কন্টেইনার শিল্পের প্রদান কেন্দ্র। বন্দর থেকে মালবাহী কন্টেইনার ভিতরের বড় শহরগুলোতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। বড় ক্রুস শিপ এখানে নোঙ্গর করার জন্য আধুনিক বন্দর গড়ে তোলা হয়েছে। হাজার হাজার পর্যটক এসে সমুদ্র তীরের রিসোর্টে ভিড় করে।
দেখলাম স্কুলের ছেলে মেয়েরা হেটে যাচ্ছে। কারোর কারোর সাথে বাবা-মা। খেয়াল করলাম ১০-১২ বছরের এক ছেলে উচ্চ স্বরে কিছু বলছে। সাথের ভদ্রলোক, হয়ত বাবা হবে, নিচু গলায় কিছু বুঝানো চেষ্টা করছেন। ওদের স্প্যানিশ ভাষা না জানা থাকাতে, কথোপকথন বেশী কিছু বুঝলাম না। তবে আমার মনে হল, ছেলে তার দাবী সময়মত পূরণ না করার জন্যে জিদ করছে, বাবা হয়ত তাকে শান্ত করার চেষ্টা করছেন। মুহূর্তেই মনটা যোজন যোজন মাইল অতিক্রম করে ফেলল; শুধু তাই না অনেক অনেক বছর পিছনে চলে গেল। মনে হল, ওই ছেলেটা আমি নিজে এবং আমার বাবা আমার দাবীটা পরে মিটিয়ে দেবার অঙ্গীকার করছেন। পৃথিবী জুড়েই পিতা-পুত্রের চরিত্রের কত না সামঞ্জস্য।
এই দিন সন্ধ্যায় যা দেখলাম, তা জীবনে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। বিকাল চারটায় জাহাজ ছাড়লো। দু’ জনেই হাহাহাটিতে কিছুটা ক্লান্ত হয়ে ছিলাম। বিছানায় শুতে না শুতেই চোখ দুটো লেগে আসলো। সাথে বিশাল বড় জাহাজের মৃদু দোলানী ঘুমের আরেক জগতে পৌঁছে দিল। ঘুম যখন ভাঙল, সূর্য তখন এলায়ে পড়েছে, কিছুক্ষণ পরেই ডুববে। ক্যাবিন সংলগ্ন ব্যাল্কনিতে চলে এলাম। প্রিয়তমা ডেকে নিলাম। সমুদ্রের উপরে বসে সূর্যকে সমুদ্রের মাঝে হারিয়ে যেতে দেখব।
সূর্য দিগন্ত রেখার কাছাকাছি চলে এলো। কে বলবে, এই সূর্যের আলোর তাপে কিছুক্ষণ আগে ঘর্মাক্ত হয়ে ক্লান্ত হয়েছিলাম। এখন তার অন্য রূপ। শান্ত, সৌম্য, এক মায়াবী চেহারা। খালি চোখ দিয়ে তাকিয়ে দেখা যাচ্ছে। যৌবনের প্রখরতা কমে গেছে। চারিদিকে রঙের খেলার আভা ছড়াচ্ছে। অনেকটা যেমন একজন প্রবীণ মানুষ জীবন সায়াহ্নে অভিজ্ঞতার আলোকে ভিতরে সব ভালোবাসা ছড়িয়ে দেন। এর মধ্যে সূর্য একটু একটু করে সমুদ্রের মাঝে হারান আরম্ভ করেছে। প্রতিটা মুহূর্ত মনে হচ্ছে প্রকৃতিকে সে নানা রঙের আলোচ্ছটা দিয়ে বিদায় জানাচ্ছে। এই তো কিছু ঘণ্টার বিদায়, তাতেই সূর্য ও আকাশের এত কষ্ট?
এ এক অনন্য সাধারণ দৃশ্য। সূর্য ধীরে ধীরে হারিয়ে গেল। আকাশ কোন ভাবে মেনে নিতে পারছিল না এই বিদায়। যেখান থেকে সূর্য চলে গেল, সেখান আরও কিছুক্ষণ বিদায়ী রং নিয়ে আকাশ কিছু একটা হারানোর কষ্টে ভুগলো। কিন্তু, কষ্ট বেশীক্ষণ স্থায়ী হল না। অন্ধকার এসে ভুলিয়ে দিল আকাশের সব দুঃখ। কিন্তু আমার মনে আরেক চিন্তা। এই সূর্য-ই পৃথিবীর আরেক প্রান্তে ভোর করছে। বাংলাদেশের সেই সুন্দরী মেয়ে একটু পরেই ঘুম দেখে উঠবে। প্রিতমকে বলবে, “ভালোবাসি, তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি।”
রাতে জাহাজের অডিটোরিয়ামে ম্যাজিক শো দেখতে গেলাম। লস ভেগাসের এক নামজাদা জাদুকর তার পুরো দল নিয়ে এসেছে। আলো, বাজনা, নৃত্যের তালে একের এক যাদু দেখিয়ে চলল। আমাদের থেকে যাদু শিখে আমাদেরকেই টেক্কা দিচ্ছে। জুয়েল আইচ, পিসি সরকারের কথা মনে হল। সেই একই যাদু পরিবেশনা এরা অনেক বেশী মোহনীয় ও গতিশীল করে তুলেছে। সেখান থেকে বের হয়ে হয়ে আগে রাতে তোলা পোর্টেট ছবি। সেখানে আরেক যাদু। প্রতিটা ছবি এত সুন্দর উঠেছে যে নিজেরাই অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম। কিন্তু এত দাম চাইল যে পকেটে কত টাকা আছে, তার একটা হিসেব মনে মনে কষতে থাকলাম।
ব্যাল্কনিতে যেয়ে অবাক হওয়ার আরেক পালা বাকী ছিল। ক্যাবিনে ফিরে ব্যাল্কনি থেকে আকাশের দিকে তাকালাম। পুরো আকাশ জুড়ে তারা চিকচিক করছে। বিশাল বড় এক চাঁদ উঠেছে। তার আলো সাগরের ঢেউয়ে যেয়ে মিশেছে। যদি ঢেউ তেমন আলোকিত হচ্ছে না, তার পরেও অন্য রকম অনন্য সুন্দর দৃশ্য তৈরি হয়েছে, “চাঁদের হাসি বাঁধ বেধেছে……”। সাথে সাগরের সেই বিরামহীন স্রোতের মূর্ছনা। ইচ্ছা করছিল সারা রাত সেখানে বসে রাতের প্রকৃতির সাথে মিশে থাকতে। কিন্তু বাতাস বেশ ঠাণ্ডা। বেশীক্ষণ আর সেখানে থাকা হল না।
৫
ফেরব্রুয়ারি ১৬, মঙ্গলবার। জাহাজ নোঙ্গর করল মেক্সিকোর কজুমেল নামের বন্দরে। আবার ভিন্ন জায়গার মানুষ ও তাদের জীবন যাত্রা দেখার জন্যে নেমে পড়লাম। বন্দরে সাথে লাগোয়া বেশ সুন্দর সাজানো, গোছানো, পরিষ্কার সুন্দর এক শহর। বন্দর থেকে বের হতেই বাস, ট্যাক্সি স্ট্যান্ড। নারিকেল, পাম, কলা ও অন্যান্য গাছ গাছালি মানুষের চোখ কাড়বেই। চোখ কাড়লে, মনে স্থায়ী করতে ও অন্যদের দেখানোর জন্যে ছবি তুলতে লাগলাম। দু জন এক সাথে ছবি তুলার জন্যে সেলফি স্টিক ব্যবহার করছিলাম। কিন্তু তাতে কি আর মন ভরে?
সবাই টুরিস্ট ও ব্যস্ত। হঠাৎ দেখি, সত্তরের কাছাকাছি বয়সের এক ভদ্রলোক এসে বললেন, তিনি আমাদের ছবি তুলে দিবেন। দেখে বুঝলাম, তিনিও আমাদের মত জাহাজ থেকে নেমেছেন। তাকে বুঝিয়ে দিলাম, আমার আই ফোন দিয়ে কিভাবে ছবি তুলতে হয়। কিন্তু বেচারা ঠিক পেরে উঠছিলেন না ছবি তুলতে। আমি আরও দু বার সহজ কাজটা দেখিয়ে আসলাম। আমরা বারে বারে পোস দিলাম। ভদ্রলোক রণে ভঙ্গ দিতে রাজী না। চেষ্টা করেই যাচ্ছেন।
এক যুবক দেখি এসে ভদ্রলোক থেকে আই ফোনটা নিয়ে পর পর কয়েকটা ছবি তুলে দিল। বিনীতভাবে বলল, “বাবা, চশমা ছাড়া ছোট কিছু দেখেন না। তা ছাড়া উনি সেল ফোনও ব্যবহার করেন না।” পুত্র সম্ভবত কোন কারণে বাবার থেকে কিছু পিছিয়ে পড়েছিল। নিশ্চয়ই কোন দোকান থেকে কিছু কিনছিল। কারণ হাতে শপিং ব্যাগ ছিল। যাই হোক, এত কিছুর পরেও, উনি আমাদের সাহায্য করতে বেচারা কত কসরত-ই না করলেন। খুব ভাল লাগল, এই ব্যস্ত পৃথিবীর একজন প্রবীণ মানুষ আমাদের সাহায্য করার আন্তরিকতা দেখে। ভাবলাম, সবাই কিংবা বেশীর ভাগ মানুষ যদি উনার মত অন্যের উপকার করার জন্যে সব সময় উদগ্রীব থাকতো।
কজুমেলে এক সময় মায়ান সভ্যতা বিস্তার করেছিল। প্রায় ১০,০০০ মায়ান সেখানে থাকতো। তবে এক করুণ ইতিহাস আছে। ১৫২০ সালে উপনিবেশিক স্পেনীয়রা চিকেন পক্সের জীবাণু নিয়ে আসে। তা থেকে মায়ানদের একেবারে বিলীন হওয়ার দশা হয়েছিল। ১৫৭০ সালে কজুমেলে মায়ানদের সংখ্যা দাড়ায় ১৮৬ জন পুরুষ এবং ১৭২ জন মহিলা। বর্তমানে প্রচুর পর্যটক আসে মায়ান সভ্যতার ধ্বংসাবেশ ও কারকাজ নিজের চোখে দেখতে। মায়ানরা এক সময়ে জ্ঞানে, প্রযুক্তিতে উৎকর্ষতা লাভ করেছিল। মায়ানদের ক্যালেন্ডারের কথা নিশ্চয়ই শুনেছেন। সেই যুগে তাদের দিনপঞ্জি ছিল এবং অনেকের মতে সেই ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ২০১২ সালের ২১ শে ডিসেম্বর পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবার কথা ছিল।
আমরা হলিউডের ছায়াছবিতে যাদের রেড ইণ্ডিয়ান হিসেবে দেখি, তাদের সাথে মায়ানদের বংশধরদের বেশ মিল। একজন মায়ানের দেখা পেয়ে গেলাম। সে রাজী হয়ে গেল, আমার ছবি তুলতে। ছবি তুলার শেষে ক্ষণিকের বন্ধুকে করমর্দন করে ধন্যবাদ ও বিদায় দিলাম। মনে মনে ভাবলাম, আমরা দু জনই বিশ্বে দুটো পুরনো সভ্যতার প্রতিনিধিত্ব করি।
৬
কিভাবে পাঁচটা দিন কেটে গেল বুঝতেই পারলাম না। সত্তরটা দেশের মানুষ জাহাজে বিভিন্ন ধরনের কাজ করে। যুক্তরাজ্য থেকে আরম্ভ করে জিম্বাবুয়ের পর্যন্ত মানুষ পেলাম। তবে ফিলিপাইন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া থেকে সব চেয়ে বেশী মানুষ কাজ করছে। শুধু পেলাম না বাংলাদেশ থেকে আসা কোন কর্মচারী। যাত্রীবাহী প্রমোদ জাহাজগুলো বাংলাদেশের শ্রমিকদের জন্য বড় একটা দ্বার উন্মোচন করে দিতে পারে। এখানকার কর্মচারীরা বেশ সন্তুষ্ট-ই মনে হল, কারণ এখানে থাকা, খাওয়ার কোন খরচ নাই। আয়ের সিংহ ভাগ সঞ্চয় হয়।
মনে আছে নিশ্চয়ই, সদা হাস্যময়ী ইকবালের কথা দিয়ে লেখাটা আরম্ভ করেছিলাম। সুযোগ পেলেই, ওকে দেখে আসতাম। এইটা সেইটা নিয়ে কথা বলতাম। সে বাড়িতে মা, বাবা, দিদি, ছোট বোনকে রেখে এসেছে। ওদের জন্যে তার মন খারাপ হয়। কিন্তু ইকবালের মাথায় পরিকল্পনা আছে। একদিন সে আবার ডাঙ্গায় ফিরে যাবে। সে তার চাকরির জন্যে সন্তুষ্ট, ঋণী। টাকা জমছে, অপেক্ষার দিন কমছে। তাই সারাদিন ব্যাপী হাসতে তার কোন ক্লান্তি আসে না। ছয় মাস কেটে গেছে। দু বছর হলেই সে মায়ের কাছে ফিরে যাবে।
মে ১১, ২০১৬
কাজী হাসান
প্রবাসী লেখক ঃ quazih@yahoo.com