চতুর্ভুজ মুখের মানুষ
জেএফকে এয়ারপোর্টে শরীফ খান কাস্টমস এন্ড ইমিগ্রেশন ডিপার্টমেন্টে নতুন জয়েন্ট করেছে। চাকরির জন্য প্রায় বছর দুয়েক আগে এপ্লাই করেছিল। এর পরে এক এক করে রিটেন, ৪ বার ভাইভা ও শেষে স্বাস্থ্য পরীক্ষা। শরীফ আশা করেছিল এইবার বুঝি জব অফার আসবে। কিন্তু না সেরকম হলো না। পাক্কা চার মাস পর ব্যাক গ্রাউন্ড চেক ক্লিয়ার এলো। চিঠি দিয়ে জানানো হলো ট্রেনিঙে যোগদান করার জন্যে। পুরো এক বছরের ট্রেনিং। সেটা সফলভাবে শেষ করার পরই চাকরির পোস্টিং পেলো।
শরীফের উত্তেজনার কমতি ছিল না। বাবা-মা'র সাথে সেই ক্লাস টেনে থাকতে যুক্তরাষ্ট্রে চলে এসেছে। তারপরে পরিবারের উপর দিয়ে কম ঝড় ঝাঁপটা যায় নি! বিদেশে আসার তিন বছরের মাথায় বাবা মারা গেলেন। যেই মা আগে কখনও ঘর থেকে বের হন নি, তিনি সংসারের হাল ধরলেন। অবশ্য শরীফ স্কুলের পাশাপাশি পার্ট টাইম জব করেছে। এর মধ্যে তার ইউনিভার্সিটির ব্যাচেলর ডিগ্রি হয়ে গেল। এখন তাকে সংসারে সাহায্য করতে হবে। ছোট দু ভাই তখনও পড়ালেখা করছে। বেচারি মা'র উপর তখন মেলা চাপ। দুটো চাকরি সাথে সংসার সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ছিল। তারপরে আবার নিউইয়র্কে বাড়ি ভাড়া ও অন্যান্য খরচ একেবারে আকাশচুম্বী।
সারা পৃথিবীর মানুষ মনে হয় এমেরিকায় এসে ভিড় করে। দেশটায় চাকরি আছে প্রচুর, কিন্তু কম্পিটিশন তার থেকে বহু গুণ বেশি। একেবারে তুখার না হলে ভালো চাকরি পাওয়া এবং টিকিয়ে রাখাটা কঠিন। শরীফের ইচ্ছা ছিল সরকারী চাকরিতে ঢুকার। ওদের বেতন ও সুযোগ সুবিধা অন্যান্য জায়গার থেকে বেশি। মায়েরও সায় ছিল শরীফের ইচ্ছাতে। চাকরি আরম্ভ করতে এতো দীর্ঘ সময় লাগার জন্যে সে একেবারে অস্থির হয়ে উঠেছিল। বন্ধুরা এদিক-সেদিক চাকরি নিয়ে চলে গেছে। কিছু অবশ্য মাষ্টার ডিগ্রি করার জন্যে ইউনিভার্সিটিতে আবার ভর্তি হয়েছে।
এমেরিকা কি সারা পৃথিবীর মধ্যেই ব্যস্ততম বিমান বন্দরগুলোর মধে অন্যতম নিউ ইয়র্কের জেএফকে এয়ারপোর্ট। নিউ ইয়র্ক বিশ্ব অর্থনৈতিক রাজধানী হওয়ায় এর গুরুত্বও অনেক। জাতি সংঘের সদর দপ্তরও এখানে। নামি-দামী মানুষের আনাগোনার কোনো শেষ নাই। এই শহরের ক্ষতি করার জন্য সন্ত্রাসী ও দুষ্কৃতকারীদের চেষ্টার অন্ত নাই। এত কিছু মাথায় রেখে এয়ারপোর্টের প্রথম সারির প্রতিরক্ষার কাজ করে কাস্টমস ও ইমিগ্রেশন অফিসাররা। এরা আবার যুক্তরাষ্ট্রের হোমল্যান্ড সিকিউরিটি মন্ত্রণালয়ের অধীনে। অফিসাররা ঠিক মত দ্রুততার সাথে দায়িত্ব পালন করছে কি-না সে জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সব সময়ে কঠোর দৃষ্টি রাখে। এতসব কারণের জন্যে যারা এখানে কাজ করার সুযোগ পায় তাদের নিজের পারদর্শিতা প্রথমে করতে হয়।
শরীফ কল্পনায় ভাবি নি যে তার প্রথম পোস্টিং জেএফকে এয়ারপোর্টে হবে। ধরেই নিয়েছিল ট্রেনিং শেষে প্রত্যন্ত কোন বর্ডারে কাজ আরম্ভ করতে হবে। সে ভেবেই রেখেছিল কয়েকবছর চাকরি হওয়ার পর নিউ ইয়র্কে বদলির জন্যে আবেদন করবে। মা বিধবা ও ছোট ভাইদের অভিভাবকের দরকার উল্লেখ করলে হয়তো ট্রান্সফার দিবে। চাকরিতে এপ্লাই করার আগে রিক্রুটর সে রকমই বলেছিল। এর থেকে জরুরী বিষয় হলো সে এখন বাসায় থেকে কাজে আসতে পারবে। প্রয়োজনে মা'কে সাহায্য করতে পারবে; ভাইদের প্রয়োজনে পাশে দাঁড়াতে পারবে।
২
নতুন জায়গায় কাজে অবশ্য একটা সমস্যা হলো। শরীফের একেবারে রাত জাগার অভ্যাস নাই। সেই ছোটবেলা থেকেই খুব বেশি হলে রাত এগারোটা পর্যন্ত সজাগ থাকতে পারতো। তার পর বিছানা না পেলে যে স্থানে থাকবে সেখানেই ঘুমিয়ে পড়তো। ট্রেনিং নেয়ার সময়ে বিষয়টার কিছু উন্নতি হয়েছিল তবে অনেক ভুগতে হয়েছিল। চাকরিতে যারা নবীন তাদের প্রথমে রাতের শিফটে কাজ করতে হয়। সেটা হলো রাতের এগারোটা থেকে সকাল সাতটা পর্যন্ত। বেচারার এখন আর কোন গত্যন্তর নাই। বিধাতার তো আর কাউকে একবারে সব সুবিধা দিয়ে দেন না।
আসলে এয়ারপোর্টের ভিতরে দিন-রাতের খুব বেশি পার্থক্য করা যায় না। সেখানে চব্বিশ ঘণ্টাই ঝকঝকে আলো জ্বলছে ও মানুষ গমগম করছে। শরীফের অস্বস্তি তিন দিনের মাথায় একেবারেই কমে গেল। প্রথম দু দিন মাথাটা ঝিমঝিম করেছিল। কিন্তু তৃতীয় দিন থেকে সেটা আর নাই। পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে কাজ করতে পারছে। নিজেকে নিয়ে খুশি হলো। মানুষ চাইলে কি-না করতে পারে। তা ছাড়া আরও কত মানুষ রাতের শিফটে কাজ করছে। এখন সে অনেক বড় হয়েছে। শিশুকালের বদ অভ্যাসগুলো ঝেড়ে ফেলতে না পারলে জীবনে এগুনো যাবে না।
শরীফের সুপারভাইজারের নাম জোনাথন। বিশাল-দেহী কৃষ্ণাঙ্গ ভদ্রলোক। তিনি চেহারা দেখলেই বুঝতে পারেন কার উপর ভরসা করা যায়। তিনি এও বুঝে ফেলেছেন এই বাঙালি ছেলেটা কাজেকর্মে অনেক উপরে উঠবে। নতুন কিছু শেখার জন্যে ছেলেটার চোখ জ্বলজ্বল করছে। তিনি এর মধ্যে শরীফকে বেশ কয়েকবার প্রশংসা করে নানা উপদেশ দিয়ে বলেছেন, “লেগে থাকো। অনেক উপরে উঠতে পারবে।” অন্যদিকে বঙ্গ সন্তান শরীফেরও বস ও কাজের পরিবেশ পছন্দ হতে লাগলো। সে নিজের কাছে নিজে পণ করলো তাকে ভালো কাজ করতেই হবে। সে বসের ভবিষ্যৎবাণীকে কোনোভাবেই ভুল হতে দিতে পারে না।
একদিন, দু দিন, তিন দিন করে সপ্তাহ, তার পর এক মাস পার হয়ে গেল। শরীফ কাজে অভ্যস্ত হয়ে উঠলো। নানান দেশের মানুষ কাগজ পত্র নিয়ে তার সামনে এসে দাঁড়ায়। পাসপোর্ট, ভিসা ও অন্যান্য কাগজপত্র ঠিক থাকলে শরীফ বলে উঠে , “ Welcome to the USA. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তোমাকে স্বাগতম।” কেউ ইংরেজি না জানলে আবার দোভাষীর সাহায্য নিতে হয়। সুপারভাইজার তার অফিস থেকে সিসি ক্যামেরার মনিটরের মাধ্যমে সবাইকে কঠিন-ভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। সামান্যতম গাফিলতি কিংবা ভুল দেখলেই সতর্ক করে দেন। তিনি বারে বারে অধস্তনদের বলে যান “কোনোভাবেই সন্ত্রাসী কিংবা অবাঞ্ছিত মানুষ যাতে ঢুকে না পরে।”
৩
রাত পৌনে একটা বাজে। রাত একটা বাজলে শরীফ লাঞ্চ ব্রেকে যাবে। এই সময়ে কিছুটা স্লো হয়ে আসে। সুরভাইজার এই সময়ে ১৫ জনের মধ্যে আট জনের ব্রেক দেন। বাকি সাত জন এই সময়ে কাজ চালিয়ে নিতে পারে। ওরা ব্রেক থেকে ফিরতে ফিরতেই তুমুল ব্যস্ততা আরম্ভ হয়ে যায়। কাছাকাছি সময়ে দুটো বোয়িং ড্রিম লাইনার, তিনটা এয়ারবাস এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকা থেকে এসে ল্যান্ড করে। লম্বা লাইন একে বেঁকে অনেক দূর ছড়িয়ে পড়ে। সে জন্য যারা রাত এগারোটায় ব্রেকে যায় তাদের চেষ্টা থাকে কমপক্ষে পাঁচ মিনিট আগে এসে লগ ইন করা।
শরীফ লাঞ্চ সেরে নির্ধারিত সময়ের সাত মিনিট আগেই তার কাউন্টারে এসে কাজ আরম্ভ করার জন্য প্রস্তুতি নিলো। সামনে তাকিয়ে দেখে আজকে লাইনটা এর মধ্যেই অন্যদিন থেকেও প্রায় দ্বিগুণ বড়। ঠিক মাথায় ঢুকল না এইটা কি করে সম্ভব। প্লেনে তো আর বাড়তি প্যাসেঞ্জার নেওয়ার উপায় নাই। তা হলে লোকের পরিমাণ বাড়ল কি করে? কাজ শুরু করার জন্য সুপারভাইজার কন্ট্রোল প্যানেল থেকে জানালেন। শরীফ সাথে সাথেই তার কাউন্টার চালু করে যাত্রীরা বৈধভাবে এসেছে কি-না তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালু করে দিলো।
একের পর এক যাত্রী আসছে। শরীফ কাগজ পত্র দেখে মার্কিন ইমিগ্রেশনের সিল লাগিয়ে বলছে, “Welcome to the USA তোমাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্বাগতম।” একই কাজ, একই কথা বলতে বলতে মাথাটা কেমন যেনো ঝিম ঝিম করে উঠল। এ রকম তো হওয়ার কথা না। গত তিন মাস এ রকম কিছু হয় নি। শরীরটা তো মোটামুটি রাত জাগার সাথে মানিয়ে নিয়েছে। একটু পানি খেতে পারলে মনে হয় ভালো লাগতো। তাকিয়ে দেখে টেবিলের কোণায় পানির কাপটা নাই। তার মানে হলো লাঞ্চ করতে কাপটা সাথে করে নিয়ে গিয়েছিল। সেটা তাড়াহুড়ার কারণে ভুল করে রেখে এসেছে। সে দ্রুত ভাবছে এখন কি করা যায়। এর মধ্যে চোখে কেমন ঝাপসা দেখা আরম্ভ করল। কিন্তু শরীরের অবস্থা তো আগত যাত্রীদের বুঝতে দেয়া যায় না। একবার ভাবল সুপারভাইজার একটা কল করবে কি-না।
কিন্তু কল করার ফুরসুৎ আর পাচ্ছে আর কৈ? এক জনের হয়ে গেলেই আরেকজন এসে হাজির হচ্ছে। কয়েকবার মাথা ঝাঁকি দিয়ে মনোযোগ বাড়ানোর চেষ্টা করল। কয়েক মিনিটের জন্য উপকার পাচ্ছে। তার পর পরই শরীরটা আরও বেশী করে ছেড়ে দিতে চাইছে। মনে হচ্ছে যে কোনো মুহূর্তে অবচেতন হয়ে পড়বে। সে রকম হলে বড় ধরণের একটা কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। শেষে চাকরি নিয়ে আবার টান পড়বে। মস্তিষ্ক আতঙ্ক ছড়িয়ে হয়তো শরীরকে সজাগ রাখতে চাইছে।
একসাথে চার জন কাউন্টারে এসে দাঁড়াল। তার মানে এরা এক পরিবারের সদস্য। শরীফ চট করে একবার তাকাল। সম্ভবত স্বামী-স্ত্রী এবং তাদের দু মেয়ে। সবাই হ্যাট পরা। কারোর বয়সই তেমন ঠাওর করতে পারলো না। তাদের শরীরের আকৃতি ও চেহারাগুলো দেখতে কেমন অদ্ভুত ধরণের। সবই কেমন লম্বা ও সরল রেখা ধাঁচের। মুখগুলো একেবারে চতুর্ভুজের মতো মানে চার কোণা। শরীরের গঠনও কিছুটা বাক্স প্রকৃতির। শরীফ বুঝল শরীরের সাথে তার মস্তিষ্কও ঠিকমতো কাজ করছে না। হঠাৎ মনে হলো তার সামনে চার জন রোবট দাঁড়িয়ে আছে।
সবচেয়ে লম্বা যে তার উচ্চতা প্রায় সাত ফুট। মানুষ এরকম লম্বা হতেই পারে। সে হাত বাড়িয়ে কাউন্টারে চারটা পাসপোর্ট রাখল। পাসপোর্টের রং দেখে শরীফ যারপরনাই অবাক হলো। রংটা একেবারে ক্যাটক্যাটে হলুদ। এই রঙের পাসপোর্ট আগে দেখেছে বলে মনে করতো পারলো না। পৃথিবীতে দুই শত'র উপরে দেশ যাচ্ছে। কোনো দেশের সরকারের হলুদ রঙের পাসপোর্ট বানানোর ইচ্ছা হতেই পারে। এইবার শরীফ নিজেকে আশ্বস্ত করলো শরীরটা খারাপ লাগলেও ব্রেনটা ঠিকঠাক কাজ করছে। কোনো রকমে সকাল সাতটা বাজলেই হলো। সরাসরি বাসায় যেয়ে লম্বা একটা ঘুম দিবে। তাতেই শরীরটা আবার চাঙ্গা হয়ে উঠবে। আগামী কাল তার সাপ্তাহিক অফ। প্রয়োজনে ভালো করে খাওয়া দাওয়া আর বিশ্রাম করে নিবে।
শরীফ সবচেয়ে উপরের পাসপোর্ট হাতে নিলো। কভারের উপর দেশের নামটা পড়লো। একবার না তিনবার। এই নামের আবার দেশ আছে না-কি। দেশের নাম মার্কারি। ইংরেজিতে লেখা সাথে আরও একটা ভাষায় কিছু লেখা। সম্ভবত একই তথ্য। কিন্তু সেই ভাষার অক্ষরগুলো কেমন বিচিত্র। সেগুলো বৃত্তের মধ্যে বৃত্ত। কোনোটার মধ্যে দুটো, কোনোটার মধ্যে আরও বেশী। মাথায় এলো লোকগুলো লম্বা লম্বা বাক্স আকৃতির আর তাদের অক্ষরগুলো সব বৃত্তের মধ্যে বৃত্ত। নিজের রসিকতায় নিজেই মুগ্ধ হলো। এইবার সে প্রথম পাতা খুলল। ছবিটা যেই পুরুষলোক পাসপোর্টগুলো এগিয়ে দিয়েছিল তাঁর চেহারার সাথে মিলল। কিন্তু জন্ম তারিখ দেখে একেবারে চক্ষু চড়ক গাছ। এইটা একেবারে অসম্ভব। এমন হতেই পারে না। কোথাও একটা বড় ধরণের ঝামেলা হচ্ছে।
সে এক এক করে বাকী তিনটা পাসপোর্টের প্রথম পাতা খুলল। একই সমস্যা। প্রিন্টিং মিস্টেক অন্তত জন্ম তারিখ নিয়ে হয় না। কৌতূহল নিয়ে এইবার ভিসার তারিখ দেখল। সেখানেও সমস্যা। এতো মার্কিন এমব্যাসির সীল না। তারিখেও বড় ধরণের গড়মিল। ওরা জেএফকে এয়ারপোর্টে এসে হাজির হলো কি করে? কি অসম্ভব জিনিস সে ভাবছে? আসলে তাঁর দৃষ্টিভ্রম হচ্ছে। হাতটা নিজের থেকেই ইমারজেন্সি বাটনে চাপ দিলো।
৪
ইমিগ্রেশন ও কাস্টম অফিসারদের ইমারজেন্সি বাটনে চাপ দেয়ার অর্থ হলো মারাত্মক কোনো হুমকি সৃষ্টি হয়েছে। সুপারভাইজার জোনাথন ছুটে এলেন। সশস্ত্র প্রহরীরা এসে শরীফের কাউন্টার ঘিরে ফেলল। সুপারভাইজার জানতে চাইলো কি বিষয়। শরীফের মুখ থেকে কোনো কথা বের হচ্ছে না। সে পাসপোর্টগুলো জোনাথনের হাতে তূলে দিলো। শরীফের বিশ্বাস সে এখনই চাকরির থেকে ফায়ার হয়ে যাবে। কারণ জোনাথন দেখবে পাসপোর্ট ও ভিসাতে কোনো সমস্যা নাই। শুধুমাত্র তার কারণে চারজন যাত্রীর এ ধরণের ভোগান্তি হচ্ছে। পত্রিকাওয়ালারা জেনে ফেললে আর মুখ দেখানোর জো থাকবে না। জেএফকে এয়ারপোর্টে আবার একটা পাতা পড়লেও পত্রিকা টিভি চ্যানেলগুলোতে বিশাল বড় খবর করে দেয়।
জোনাথন চার জনকে নিয়ে পাশের অফিসের দিকে রওয়ানা দিলেন। শরীফকে বললেন ইন্সিডেন্ট রিপোর্ট ফিল আপ করতে। তার মানে হলো শরীফকে এখন পুরো ঘটনাটার আদ্যোপান্ত লিখিত আকারে জমা দিতে হবে। ভবিষ্যতে তদন্ত হলে এই রিপোর্ট পরীক্ষা করা হবে। এখনই লিখতে বলার কারণ হতে পারে স্মরণে যা যা আছে তার সবই বিস্তারিত লিখতে হবে। পরবর্তীতে সূক্ষ্ণ কিছু ভুলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। শরীফ কাউন্টার বন্ধ করে চলল রিপোর্ট লিখতে। এই সাসপেন্সের মধ্যে অবশ্য একটা ভালো জিনিস হয়েছে। শরীফের শরীরের যে ঝিম ঝিম ভাবটা ছিল সেটা একবারেই সেরে গেছে। তার শরীর এবং মন এখন পূর্ণ সজাগ ও সতেজ।
চারজনই কোনো প্রতিবাদ না করে জোনাথনের পিছনে পিছনে একটা কনফিডেনসিয়েল রুমের ভিতর যেয়ে ঢুকল। অবশ্য এর মধ্যে এদেরকে দু বার করে সার্চ করা হয়েছে। নিশ্চিত করা হয়েছে তাদের কাছে কোনো অস্ত্র কিংবা কোনো গোলা বারুদ নাই। সন্দেহজনক কিছু না পেয়ে নিরাপত্তা রক্ষীদের মধ্যে এক ধরণের স্বস্তি এলো। তারপরেও অফিসের চারিদিকে কড়া পাহারার ব্যবস্থা করা হলো। সমস্যাটা হলো ওদের সাথে ইংরেজিতে কথা বলা যাচ্ছে না। হাতের ইশারায় জোনাথন বেশ কয়েকবার জানতে চাইলো, “তোমরা কোন প্লেনে করে কোন দেশ থেকে এসেছ। তোমাদের ভাষা কি। না কোনটারই উত্তর পাওয়া গেল না।” এইসবের সুরাহা না হলে কোনোভাবেই তাদের ছাড়া যায় না। কে জানে এরা আবার ছদ্মবেশী সন্ত্রাসী কি-না। মাথার মধ্যে কি না কি মতলব আছে!
ওদেরকে বসিয়ে পাসপোর্টগুলো নিয়ে জোনাথন উপর তলায় রিসার্চ এন্ড এনালাইসিস রুমে এলো। প্রথমে লেসার দিয়ে স্ক্যান করা হলো। পজিটিভ রেজাল্ট। তার মানে ভুয়া না। কোন রাষ্ট্র এই পাসপোর্টগুলো ইস্যু করেছে। এইবার রাষ্ট্রের নাম নিয়ে গবেষণা আরম্ভ হলো। মার্কারি নামের কোনো দেশের হদিস পাওয়া গেল না। সৌর মণ্ডলের সবচেয়ে ছোট গ্রহের নাম হলো মার্কারি। সেখান থেকে নিশ্চয়ই এখানে কেউ ভ্রমণ করতে আসে নি। তবে মার্কারি নামের একটা ধাতব পদার্থ আছে। বাংলায় যার নাম পারদ। এই পদার্থের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে। রুম তাপমাত্রায় এটা তরল থাকে।
না এগুলো কাজের তথ্য না। সবচেয়ে বেশী সমস্যা হচ্ছে জন্ম তারিখ নিয়ে। এই পর্যন্ত এয়ারপোর্টের উপস্থিত সব সিনিয়র অফিসার এসে পাসপোর্ট পরীক্ষা করে গেছে। কিন্তু কেউ কোনো যুতসই ব্যাখ্যা দিতে পারছে না। মার্কারি নামে কোনো দেশ যদি না থাকে তা হলে পাসপোর্ট স্ক্যানে কেনো বলছে জেনুইন ডকুমেন্ট। এর মধ্যে ওয়াশিংটনে জরুরী ম্যাসেজ পাঠান হলো। চারজনের নামের মধ্যে তেমন কোনো বৈশিষ্ট্য নাই। বাব, মায়ের নাম রিচার্ড ও মেরী। মেয়েরা হলো জেনি ও শেরি। লাস্ট নাম সবার-ই স্মিথ। এই ধরণের নাম পুরো খৃস্টান দুনিয়া প্রচুর আছে।
বর্তমানে ২০১৯ সাল চলছে। বাবার জন্ম সাল লেখা ২০৫৯। মায়ের ২০৬১। মেয়ে দুটো সম্ভবত যমজ। একই জন্ম তারিখ ২০৮৫। একজন সিনিয়র অফিসার কমেন্ট করলেন, “সব রাবিশ। ওই চার জন আমাদের সাথে প্র্যাঙ্ক (prank) করছে। পুলিশে কাছে হ্যান্ড ওভার করে দেয়া হোক। ওদের থেকে প্যাঁদানি খেলে সব ফাইজল্যামো ফাঁস করে দিবে।” অন্যরা একমত হতে পারল না। কাগজপত্র সন্তোষজনক না হলে একমাত্র ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস ডিপার্টমেন্ট ফিরতি প্লেনে ফেরত পাঠিয়ে দিতে পারে। পুলিশে হাতে দিলে আইনজীবীরা বেল আউট করে এমেরিকার বুকে বের করে আনতে পারে। একেবারের উপর থেকে নির্দেশ আছে এ রকম পরিস্থিতি ঠেকানোর জন্যে সব ধরণের চেষ্টাই যাতে করা হয়।
আরেকজন অফিসার মন্তব্য করলেন, “ব্যাটারা সন্ত্রাসী হতে পারে। আমাদের ভাঁওতা দেয়ার চেষ্টা করছে। এয়ারপোর্ট জুড়ে রেড এলার্ট ঘোষণা করা উচিৎ।” আরেক জন বলল, “শুনলাম নতুন অফিসার ওদের আবিষ্কার করেছে। কৃতিত্ব নেয়ার জন্যে এটা ওর কোনো কারসাজি হতে পারে।” সুপারভাইজার জোনাথন সাথে সাথে প্রতিবাদ করে উঠলো, “না শরীফ খুবই সিনিসিয়ার অফিসার। ও এ রকম কাজ করবে না।” সাথেই সাথেই প্রথম-জন সন্দেহের সুরে উত্তর দিলো, “কি বললে অফিসারের নাম শরীফ। বিদেশী নাম। এর সাথে ও নির্ঘাত জড়িত।” এর মধ্যে ওয়াশিংটন থেকে উত্তর এলো, “জেএফকে এয়ারপোর্টের কাস্টমস ও ইমিগ্রেশন ডিপার্টমেন্টের লোকজনরা কি এখন কাজে মধ্যে নেশা করা আরম্ভ করেছে। তারা কি সব উল্টা পাল্টা ম্যাসেজ পাঠাচ্ছে।”
খবর পেয়ে নিউ ইয়র্ক কাস্টমস ও ইমিগ্রেশন ডিপার্টমেন্টের প্রধান জেসন সোয়ান রুমে ঢুকলেন। তাকে আবার প্রথম থেকে পুরো ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়ে তার হাতে চারটা পাসপোর্ট দেয়া হলো। তিনি নিজের চোখে পাসপোর্টের প্রতিটা পাতার প্রতিটা লেখা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করলেন। সবাই একেবারে চুপ। রাশভারী জেসন এক বার রেগে উঠলেই বিপদ। একেবারে চিৎকার করে হুলস্থূল করে ফেলেন। অন দা স্পট মানুষ ফায়ার মানে চাকরি থেকে বিদায় করে দেন। প্রতিটা মিটিঙে তিনি অধস্তনদের এ কথা পরিষ্কার করে বলেন, কাস্টমস এন্ড ইমিগ্রেশন ডিপার্টমেন্ট দেশকে নিরাপদ রাখতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে। এ জন্য তিনি সামান্যতম গাফিলতি সহ্য করবেন না।
চীফ জেসন সোয়ান তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষ করে শুধু একটা শব্দ উচ্চারণ করলেন, “হুম।” পরের দু মিনিট চোখ বন্ধ করে নিঃশব্দে কিছু একটা নিয়ে ভাবতে লাগলেন। অন্যদের মুখ থেকে কোনো শব্দ বের হলো না। তাদের জানা আছে এ রকম সময়ে চীফের মনোযোগ নষ্ট করলে তিনি খুবই ক্ষেপে যাবেন। খুব জটিল সমস্যার সমাধান বের করতে হলে তিনি এই কাজটা করেন। তিনি চোখ খুলে বললেন, “আমি লোকগুলোর সাথে দেখা করবো।” কথাটা শেষ হতে না হতেই তিনি হাঁটা আরম্ভ করলেন। রুমের সবাই তাকে অনুসরণ করা আরম্ভ করলো। তিনি একবার চোখ বড় বড় করে পিছন দিকে ফিরে তাকালেন। তার মানে হলো তার সাথে এতো মানুষ আসার দরকার নাই।
যাত্রী চারজনকে যে রুমে রাখা হয়েছিল, তার দরজার সামনে চারজন সশস্ত্র প্রহরী। একটু দূরে শরীফও দাঁড়িয়ে ছিল। তার শিফট বেশ আগেই শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু সে স্বেচ্ছায় অপেক্ষা করছে। সে নতুন হলেও জানতো বড় ধরণের সমস্যা হলে চীফ নিজে চলে আসেন। তখন সংশ্লিষ্ট অফিসার না থাকলে তিনি খুব বিরক্ত হন। যাই হোক শরীফকে দেখে চীফ দাঁড়ালেন। ওকে দু চারটে প্রশ্ন করে দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন। চীফ ও তার দু জন সহযোগী রুমের ভিতর ঢুকল।
অভ্যাগতদের ভোর তিনটার দিকে ওই রুমে রেখে যাওয়া হয়েছিল। দু ঘণ্টা পর বোতল পানি, বিস্কুট ও কলা দিয়ে আসা হয়। তখন প্রহরীরা দেখেছিল ভদ্রলোক একটা বই পড়ছেন। অন্য তিনজন মাটিতে শুয়ে ঘুমাচ্ছে। তারপরে তারা বাইরে বের হয়ে আসে। নিজেরা ফিসফিস করে বলা বলি করেছিল, “আহারে ওরা নিশ্চয়ই খুবই ক্লান্ত। কতদূর থেকে আর কতক্ষণ প্লেন চড়ে এসেছে, সেটা কে জানে? এতক্ষণ আটকে রাখার কোনো মানে হয় না। কাগজপত্র পরীক্ষা করতে এতক্ষণ লাগানোর কি থাকতে পারে?” এরা ধরেই নিলো চীফ এবার নিজে সব হিল্লে করে ফেলবেন। পরিবারটা নিজেদের গন্তব্যে যেয়ে বিশ্রাম করতে পারবে।
রুমটার কোনো জানালা নাই। সাথে শুধু লাগোয়া বাথরুম। চীফ জেসন সোয়ান আর দু জন সহযোগী দরজা খুলে ঢুকে দেখেন ভিতরে কেউ নাই। তিনজনই একসাথে ছুটল বাথরুমে দিকে। না সেখানেও কারোর টিকিটাও দেখা যাচ্ছে না। একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করলো। একেবারে অসম্ভব ব্যাপার। রুমের জানালা নাই, দরজার সামনে গার্ড দাঁড়িয়ে। এ রকম জায়গা থেকে পালান যাবে না। তা হলে গেল কই? সাথে সাথেই রেড এলার্ট চালু হয়ে গেল। এয়ারপোর্টের সব দরজা বন্ধ করে দেয়া হলো। যাতে কেউ ঢুকতে কিংবা বের হতে না পারে। চারজন অভ্যাগতের বর্ণনা দিয়ে সার্চ টিমগুলোকে সাথে সাথেই খুঁজতে লাগান হলো। নিউ ইয়র্কের পুলিশকে বলা হলো যে কোনো মূল্যে এদের খুঁজে বের করতে হবে।
একদল বিশেষজ্ঞ সিসি টিভি ক্যামেরার ফুটেজ নিয়ে পড়লো। ওই চারজনকে ভিডিও পাওয়া গেল। রুমের ভিতরে দুটো ক্যামেরা ছিল। সর্ব শেষ রেকর্ডিঙে দেখা যাচ্ছে পুরুষ মানুষটা চেয়ারে বসে বই পড়ছে আর অন্যরা মেঝেতে ঘুমাচ্ছে। তারপরে ক্যামেরার সামনে ইলেকট্রিক স্পার্ক হলো। এর পর ক্যামেরাগুলো ফিড পাঠান বন্ধ করে দিয়েছে। মানে যেইটা হয় না। তাই হয়েছে। দুটো ক্যামেরাই একসাথে বিকল হয়ে গিয়েছে। টেকনিশিয়ান যেয়ে ক্যামেরা পাল্টে দেয়া মাত্রই আবার রুম থেকে ফিড আসা আরম্ভ করল।
চীফ জেসোন সোয়ান নিজেও সার্চ টিমের সাথে খোঁজা-খুঁজি করলেন। সিটি পুলিশও জানিয়ে দিলো এয়ারপোর্ট এলাকা থেকে ওরকম মানুষরা বের হয় নি। প্রায় ২০ মাইল এলাকা তন্ন তন্ন করে খোঁজা হয়েছে কিন্তু কোনো ফল পাওয়া যায় নি। সংশ্লিষ্ট কারোর মাথায় এলো না তা হলে লোকগুলো গেল কোথায়? একেবারে তো বাতাসের সাথে মিলে যেয়ে উধাও হয়ে যেতে পারে না। এর মধ্যে টিভি চ্যানেল গুলো এয়ারপোর্ট থেকে লাইভ সম্প্রচার আরম্ভ করল। অনেকেই নিজেদের কল্পনার সাথে আবেগ মিশিয়ে নানা কথা বলে ইন্টার্ভিউ দিতে লাগল। পুরো নিউ ইয়র্ক শহরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লো। তা হলে কি নতুন করে শহরে সন্ত্রাসী আক্রমণ হতে চলেছে? দেশের অন্য এয়ারপোর্টগুলোকে আরও সতর্ক হতে বলা হলো।
সন্ধ্যা ছয়টায় কি হয়েছে এবং কি করণীয় বিষয়ে হোমল্যান্ড সিকিউরিটি এবং কাস্টমস ও ইমিগ্রেশন ডিপার্টমেন্টের উচ্চ পদস্থ অফিসারদের মিটিং বসলো। মিটিঙে শরীফকেও রাখা হলো; যদি কারোর তার থেকে কিছু জানার থাকে। সেক্রেটারি (বাংলাদেশের মন্ত্রীর সমকক্ষ) সাহেব নিজে চলে এলেন। তিনি বললেন প্রেসিডেন্ট বলে দিয়েছেন মিটিঙের ফলাফল যাতে তাকে ব্যাখ্যা করা হয়। তার থেকে বড় বিষয় হলো জনগণকে আশ্বস্ত করতে না পারলে সমূহ বিপদ। মাত্র কয়েকমাস পর নির্বাচন। অন্যদিকে বিরোধী দল বলে বসবে সরকার জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। মিটিঙে একের পর এক বিশ্লেষণ আসতে লাগল। কিন্তু কোনো উত্তরেই সেক্রেটারি সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। ওইদিকে চীফ জেসন নীরবে গম্ভীর হয়ে সবার কথা শুনছিলেন; কিন্তু নিজে একেবারে চুপ ছিলেন।
সেক্রেটারি এইবার চীফের দিকে তাকালেন। তার মানে তিনি চীফের ব্যাখ্যা শুনতে চান। তিনি শরীফের দিকে তাকিয়ে বললেন, “এই নবীন অফিসার সবাইকে কিছু বলতে চায়। আমি তার বক্তব্য নিয়ে ইতিমধ্যে কিছু গবেষণা করেছি এবং তার যুক্তির গ্রহণযোগ্যতা আছে বলে মনে করছি।” কথাটা শেষ করে তিনি শরীফের দিকে তাকালেন। তার দেখাদেখি মিটিঙে উপস্থিত সবাই শরীফের দিকে দৃষ্টি দিলো।
এইবার শরীফ কথা বলা আরম্ভ করলো, “ নব্বুইয়ের দশকে অনেকটা একই ধরণের ঘটনা টোকিওতে ঘটেছিল বলে শোনা যায়। সেখানে একজন যাত্রী এসে হাজির হয় যার পাসপোর্টে লেখা দেশের নাম কোথাও খুঁজে পায়া যায় নি। সে অবশ্য ইংরেজিসহ আরও কয়েকটা ভাষায় কথা বলতে পারত। সে দাবী করে তার দেশ হাজার বছরের পুরনো। তাকে এয়ারপোর্টে ১৪ ঘণ্টা আটকে রাখার পর একটা হোটেলের ১৫ তলায় স্থানান্তর করা হয়। তারও দরজার বাইরে সশস্ত্র পাহারা ছিল। সেও রুম থেকে উধাও হয়ে হায়। সারা টোকিও শহর তন্ন তন্ন করে খুঁজে তাকে পাওয়া যায়নি।”
হোমল্যান্ডের সিকিউরিটির উচ্চ পদের একজন বিরক্ত হয়ে টিপ্পনী কাটলেন, “আমরা এখানে রূপকথার গল্প শুনতে আসি নি। আমরা মিটিং করছি আজকের ঘটনা প্রবাহ কোন দিকে যাচ্ছে সেটা বের করার জন্য।” বাঙালি ছেলে শরীফ একটু থেমে নিয়ে আবার বলে চলল, “কোয়ান্টাম ফিজিক্স বলে একটা সাবজেক্ট আছে। সেখানকার তত্ত্ব অনুযায়ী আমাদের সমান্তরালে অসংখ্য বিশ্ব অবস্থান করছে। আমাদের বিজ্ঞান এখনও বের করতে পারে নি, কি করে এক বিশ্ব থেকে আরেক বিশ্বে কেমন করে যাওয়া যায়। তবে সমান্তরাল বিশ্বের লোকরা হয়তো জানে আমাদের বিশ্বে কি করে আসতে হয়। আমার দৃঢ় বিশ্বাস আমার কাউন্তারের সামনে যে চার জন এসে দাঁড়িয়েছিল, তারা আমাদেরকে সফর করতে এসেছিল। কিন্তু আমরা তাদের দীর্ঘ সময় আটকে রেখেছি। তারা কষ্ট পেয়েছে এবং হতাশ হয়েছে। সে জন্য তারা চলে যেতে বাধ্য হয়”।
একটি আগে যিনি টিপ্পনী কেটেছিলেন তিনি ব্যঙ্গ সুরে বলা আরম্ভ করলেন, “কি যে সব গাঁজাখুরি গল্প বলছ। তা হলে বল দেখি যুবক ওদের পাসপোর্টে এমন দেশের নাম কেমন করে এলো যার কোনো অস্তিত্ব নাই? এবং পাসপোর্টের ভবিষ্যতের তারিখ-ই বা আসে কি করে?”
জুনিয়র অফিসার শরীফ ছোট দুটো কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে বলতে লাগল, “আমাদের এখানে যেই বছর চলছে সমান্তরাল কোনো বিশ্বগুলোর কেউ হয়তো আমাদের থেকে এগিয়ে আর কেউবা হয়তো পিছিয়ে আছে। আমাদের অভ্যাগতরা যারা এসেছিলেন, তারা আমাদের থেকে প্রায় অর্ধ শতাধিক বছর এগিয়ে। আর ওদের বিশ্বের যে দেশ থেকে এসেছিল তার নাম মার্কারি; যেই নামে আমাদের বিশ্ব কোনো দেশ নাই। তবে আমি একটা বিষয় এখনও বের করতে পারি নি ওদেরকে পাসপোর্টে ইংরেজি লেখা এলো কি করে। হয়তো ওদের বিশ্ব আমাদের বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সমান্তরাল হয়ে চলছে। কিন্তু ওদের সময় মানে আমি বলতে চাচ্ছি বছর ওরা আমাদের থেকে এগিয়ে গেছে। আমাদের সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ভাষা ইংরেজি ওদের ডকুমেন্টে এখনও থেকে গেছে। যেমন আমাদের কিছু কিছু ডকুমেন্টে এখনও ল্যাটিন ব্যবহার হয়। কিন্তু আমরা কেউ ল্যাটিন ভাষায় কথা বলি না। অথবা ওরা হয়তো ভেবে রেখেছে ভবিষ্যতে কখনও আমাদের যোগাযোগ করতে হলে ইংরেজি ভাষার দরকার হতে পারে।”
(রচনাকালঃ ২০১৯)