selective focus photography of pink petaled flower

সমাপান্তে 

বর্ষাকাল। তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে। চারিদিকে প্যাচ প্যাচে কাদা। এর মধ্যে জীর্ণ শরীরের শামসু কবর খুঁড়ে চলেছে। বৃষ্টির পানি কবরের গর্তে চলে আসায় বেশ ঝামেলা হচ্ছে। কবর খোঁড়া শেষ হলে তাকে ছুটতে হবে মৃতের গোসল দেওয়ার জন্যে। তার পরেই ফিরে আসতে হবে; এই কবরের এখানে। পানি একটা বালটি দিয়ে ছেঁচে ফেলতে হবে। মৃতের আত্মীয় স্বজনেরা যখন জানাজা পড়ে লাশ নিয়ে আসবে, তখন যাতে সব কিছু তৈরী থাকে। এই সবগুলো কাজ সারতে হবে, রাতের অন্ধর নামার আগে। 

শামসু। পুরো নাম সৈয়দ শামসুল ইসলাম। অচিন পুরের এক অজো পাড়া গাঁয়ে সে একটা কুঁড়ে ঘর বানিয়ে থাকা আরম্ভ করেছে আজ প্রায় বছর দুয়েক হলো। একাই থাকে। মানুষ জনের সাথে তেমন কোন যোগাযোগ নাই। শুধু একটা সময় তাকে পরম বন্ধু হিসেবে পাওয়া যায়। যখন কারোর মৃত্যু হয়। সব চেয়ে কাছের যে মসজিদ, তা প্রায় পায়ে হাটা রাস্তায় ঘণ্টা খানেকের পথ। এত লম্বা পথ হেটে মসজিদের ইমাম এই দিকে সহজে আসতে চায় না। যদি কেউ মোটা সালামি দিয়ে আনে; তবে অবশ্য অন্য কথা। 

কবর খোদক শামসু ঠিক এর বিপরিত। আশে পাশে যে গ্রামেই কারোর মৃত্যু হোক, তাকে সেখানে যেতেই হবে। মসজিদের ইমাম আসলে তার দায়িত্ব কিছুটা কম। ইমাম সাহেব তখন মৃত দেহের গোসল করিয়ে জানাযা পড়ান। কিন্তু ইমাম না আসলে কবর খোঁড়া, গোসল করানো-- দুটো কাজই শামসুর । আবার অনেক সময় আত্মীয় স্বজনদের বলে দিতে হয়, জানাজা নামাজ পড়ানোর নিয়ম কানুন। আজ পর্যন্ত কেও দেখেনি খোদক শামসু কারো থেকে কোন পারিশ্রমিক নিয়েছে, তার কাজের জন্যে। তবে কেউ খুব জোরাজুরি করলে, বলে আমাকে কিছু চাল দিতে পারেন। 

শামসুকে সপ্তাহের বেশির ভাগ দিন ব্যস্ত থাকতে হয়। গ্রামের কোনো মৃত্যু না হলেও, তার কাছে খবর আসে মুমূর্ষু মানুষজনদের কথা। এটা একটা অঘোষিত নিয়ম। এ রকম পরিবারের মুরুব্বিদের শামসু প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা দিয়ে আসে। নিজেও দেখে আসে দাফন আর গোসলের জায়গা। সাথে সাথে পরামর্শ দেয় কথা থেকে দাফনের কাপড় কিনলে সুবিধা হবে। 

২ 

আজ শামসুর জীবনের বড় একটা পরীক্ষা। কাল গভীর রাতে উত্তর পাড়ায় আগুন লেগেছিল। সিদ্দিক বাড়ির একই পরিবারের পাঁচ জন পুড়ে মারা গেছে। লাশ পুড়ে দেখতে ভয়াবহ হয়ে গেছে। ইমাম সাহেব বলে দিলেন, তার পক্ষে গোসল দেওয়া সম্ভব না । কিন্তু তিনি জানাজা পড়িয়ে দিবেন। এখন শামসুকেই পাঁচটা মৃতের গোসল, কবর খোড়া আর দাফন, সবই করতে হবে। 

মৃতদের শরীরগুলো দেখে শামসুও আৎকিয়ে উঠলো। কিন্তু তাকে তো পারতেই হবে। কারণ সে এই কাজ না করলে আর কেউ এ কাজ করবে না। মৃতদের অসম্মান হবে। তা ছাড়া আগুন আর আগুনে পুড়ে মৃত্যু নিয়ে তার নিজের একটা ইতিহাস আছে। 

৩ 

সৈয়দ মুনিরুল ইসলাম আর মুনিরা বেগম ছিলেন শামসুর বাবা-মা। তার বাবা ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি থেকে পাশ করে বিলাতে গিয়েছিলেন। দেশে এসে বিয়ে করলেন মুনিরাকে। দু জনের নাম একই হওয়াতে প্রচুর হাসা হসি হয়েছিল সে সময়ে। 

সেই পাকিস্থান আমলের শেষ দিক কার কথা। সচ্ছল ছিল পরিবার। কাজ, আনন্দ আর হৈ চৈ নিয়ে সুখের সংসার ছিল মুনির আর মুনিরার। এর মধ্যেই এক দিন আবিষ্কার হল, মুনিরা গর্ভবতী। বিষয়টা হল একেবারেই ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের ইচ্ছায়। 

মুনিরার খুবই ভয় ছিল বাচচা হওয়ার ব্যাপারটা নিয়ে । বাচ্চা হওয়ার কষ্টটা সে নিতে পারবে তো! যদি তার মৃত্যু হয়। ইঞ্জিনিয়ার মুনির কথাটা হেসেই উড়িয়ে দিলেন, আরে দূর দূর; পৃথিবীতে প্রতি দিন হাজার হাজার শিশু জন্ম নিচ্ছে। তখন কয়টা-ই মা মারা যাচ্ছে? 

কিন্তু মুনিরার কথাই ঠিক হলো। শামসুর জন্ম হল ঠিক ঠাক করে; সুস্থ সবল বাচ্চা হল। মুনিরার পেটে ইনফেকশান হল শিশু প্রসবের জটিলতা থেকে। ডাক্তাররা অনেক চেষ্টাই করলো। ভাগ্যটা নেহায়েতই মন্দ। নব জাতক আর তার বাবাকে রেখে, মুনিরাকে অনেক অনেক দূরের না ফেরার দেশে চলে গেল। 

বাঙালি সমাজে যা হয়; কিছু দিনের যেতে না যেতেই আত্মীয়-স্বজন আর বন্ধু-বান্ধবরা ধরল মুনিরকে বিয়ে করার জন্যে। কিন্তু না তিনি বিয়ে করবেন না । শুধু তার মনে হতে লাগলো, তার যদি বাচ্চা হওয়ার ইচ্ছেটা না হতো, তা হলে মুনিরা আজ তার পাশেই থাকতো। পণ করলেন শামসুর মধ্যেই তিনি মুনিরাকে খুঁজে নিবেন। নিজের হাতে শামসুকে মানুষ করবেন । তার পরে যখন পরকালে মুনিরার সাথে দেখা হবে , তখন বলবেন রসিকতা করে, খুব তো ফাঁকি দিয়ে চলে এসেছিলে। ভেবেছিলে ওকে মানুষ করতে পারবো না। দেখো ও এখন কত বড় ডাক্তার। 

সৈয়দ মুনিরুল ইসলাম ছেলেকে ডাক্তার বানানোর পরিকল্পনা নেন, মুনিরার মৃত্যুর সাথে সাথেই। তার বদ্ধমূল ধারনা ছিল, যদি ডাক্তারা নিয়ম অনুযায়ী সাবধানতা নিয়ে বাচ্চার ডেলিভারি করাতো, তা হলে মুনিরার ইনফেকশান হত না। শামসু এই ছোট বয়সেই মা হারা হত না; মাতৃ দুধ থেকে বঞ্চিত হত না। 

বেচারা মুনিরুল ইসলাম বেশী দিন চাকরীটা টিকাতে পারলেন না। কাজে মন বসতো না। মুনিরার মৃত্যুর অপরাধ বোধ সব সময়ে তাকে আচ্ছন্ন করে রাখতো। চাকরিটা ছেড়ে দিলেন। ঢাকায় যা সহায় সম্পত্তি ছিল, সব বিক্রী করে দিলেন । 

মুনিরুল ইসলাম শামসুকে নিয়ে মফঃস্বল শহরে চলে আসলেন। এখানে ঢাকা থেকে খরচ পত্র কম। যা টাকা পয়সা হাতে আছে আর গ্রামে ধানী জমির রোজগার থেকে দু জনের ছোট সংসার বেশ চলে যাবে। 

দেখতে দেখতে শামসু বড় হতে লাগলো। স্কুলে ভর্তি হলো। এক এক করে উপরের ক্লাসে উঠতে লাগলো। মুনিরুল ইসলাম একাধারে বাবা আর মা দু জনের ভূমিকায় দায়িত্ব পালন করতে থাকলেন। শামসু বহু বার রাতে ঘুম ভেঙ্গে দেখেছে; বাবা অপলক নয়নে তাকিয়ে আছেন; দেয়ালে টাঙানো মায়ের ছবিটার দিকে। মাঝে মাঝে মনে হত চোখ দুটো চিক চিক করছে, নিশ্চয়ই অশ্রু হবে। মাঝে মাঝে আবার দু হাত দিয়ে চোখ মুছতেন। 

পাড়ার কিছু ছেলে এসে মুনিরুল ইসলামকে প্রস্তাব দিল, তাদের রাজনৈতিক দলের নেতা হওয়ার জন্যে। প্রথমে না করলেও পরে তিনি রাজী হলেন। ভাবলেন বেশ তো সময়টা কেটে যাবে আর এই সুযোগে এলাকার মানুষদেরও যদি কিছু উপকার করা যায়। শামসু স্কুলে যাচ্ছে, এখন তার আগের মত ব্যস্ত থাকতে হয় না। 

রাজনীতিতে নামার পরে মুনিরুল ইসলামের অনেক ভক্ত সৃস্টি হলো।তার মত নিবেদিত প্রাণ, পরোপকারী সৎ মানুষ তারা আগে দেখেছে বলে মনে করতে পারলো না। আর সাথে সাথেই এলাকার প্রভাবশালীরা হলো তার শত্রু। নির্বাচনের তিন দিন আগে মুনিরুল ইসলামের বাড়িতে আগুন লাগলো। পাড়ার মানুষজন যখন মুনিরুল ইসলামকে দরজা ভেঙ্গে বের করলো, তখন তার শরীরের প্রায় পুরোটাই পুড়ে গেছে। কিন্তু শামসু একেবারেই অক্ষত থেকে গেল। ভাগ্যক্রমে আগুন তার ঘরে পৌছনোর আগেই, তাকে বের করা হয়েছিল। 

এই ঘটনার পরে মুনিরুল ইসলাম তিন দিন বেঁচে ছিলেন। দ্বিতীয় দিন একবার জ্ঞান ফিরে আসে। অস্পষ্ট গলায় শামসুর সাথে কিছু কথা বললেন। 

মুনিরুল ইসলাম জানালেন, তার খুবই কষ্ট হচ্ছে শামসুকে একা এই পৃথিবীতে রেখে যেতে। তাকে আরো দুটো যন্ত্রণা নিয়ে মরতে হচ্ছে। মুনিরার মৃত্যুর মতো; নিজের মৃত্যুর জন্যও, নিজেকে তিনি দায়ী করছেন। কেন যে রাজনীতি করতে গেলেন! শেষে শামসুকে বললেন তার ব্যান্ডেজ দেয়া হাতে হাত রাখতে। বললেন, বাবা পারলে আমার জন্যে মক্কায় যাস, হজ্ব করিস। হজ্ব করলে সব গুনাহ মাফ হয়ে যাবে; তোর-আমার দু জনেরই। এত গুনাহ নিয়ে তিনি কি করে আল্লাহর সামনে যেয়ে দাঁড়াবেন, মুনিরা মানে তার মাকেই বা কি করে মুখ দেখাবেন। 

মুনিরুল ইসলাম যখন মারা যান, শামসু তখন ক্লাস এইটের ছাত্র। বাবা শামসুকে তার সম্পত্তির আর অর্থের কোনো খবর দিয়ে যান নি। প্রথমের কয়েক দিন পরিচিত মানুষরা তাকে ডেকে খাওয়া দিলেও সপ্তাহ খানেকের মধ্যে তারা নীরব হয়ে পড়লো। সে বুঝলো, বাঁচতে হলে আয় করতে হবে। কাজ করতে হবে। কিন্তু না ছোট মফস্বল শহরে কোন কাজ খুঁজে পেল না; কিংবা হয়ত কেউ কাজ দেবার জন্যে প্রস্তুতও ছিল না।

৪ 

ইঞ্জিনিয়ার পুত্র সৈয়দ শামসুল ইসলাম ঢাকা শহরে এসে অনেক ধরনের কাজই করলো। প্রথমে কাজ পেল এক মুদির দোকানে। পাইকারি বাজারে মালিকের সাথে যেয়ে মাল কিনে নিয়ে আসতে হত। ভারী জিনিস প্রথমে রিকশা ভ্যানে তুলতে হত, পরে আবার নামিয়ে দোকানে সাজিয়ে রাখতে হত। পুরোটাই দৈহিক পরিশ্রমের কাজ। খুব কষ্ট হত। আগের তো আর কখনো এ রকম কাজ করে নি। তার পরে মালিকের ছিল তুমুল মেজাজ। একটু এই দিক হলেই বকা-ঝকা, মারপিট আরম্ভ হয়ে যেত। 

দাঁতে দাঁত চেপে বছর খানেক কাজ করলো। দোকানের এক খদ্দের বাস কনট্রাকটারির কাজের ব্যবস্থা করে দিল। তার পরে কিছু দিনের মধ্যে হয়ে গেল বাসের ড্রাইভার। আয় বাড়ল অনেক গুণ। কিন্তু হরতালের মধ্যে বিক্ষোভকারিরা বাসে আগুন দিল। অল্পের জন্যে প্রাণে বাঁচল। কিন্তু বাসের ছয় যাত্রী তার চোখের সামনে পুড়ে ছাই হল। ইচ্ছা থাকলেও কোন সাহায্য করতে পারলো না। সাথে সাথেই সিদ্ধান্ত নিল, এই চাকুরি তার জনে না। আগুন সে একেবারে সহ্য করতে পারে না, আগুন যে সর্বগ্রাসী, তার সুখ আর বাবাকে গ্রাস করেছে। 

গার্মেন্টসে শামসু যখন কাজ আরম্ভ করলো, তখন তার বয়স তিরিশের উপরে। ঢাকা শহরে তখন নতুন গার্মেন্টস শিল্প চালু হচ্ছিল। একে একে কারখানার সব কাজে পটু হয়ে পড়ল; কাপড় কাটা, সেলাই, ভাঁজ থেকে আরম্ভ করে ট্রাকে উঠানো পর্যন্ত। আয় যা হতো, তা নিয়ে তার কখনই কোনো অভিযোগ ছিল না। 

চাকরির তিন বছরের মাথায় শামসুন্নেসা একই গার্মেন্টসে কাজ নিল। প্রথম দেখাতেই শামসুনকে শামসুর ভালো লেগে গেল। প্রথমে পরিচয়,তার পরে ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠতা, প্রণয়, আর বিয়ে। বিয়ের রাতেই শামসু শামসুনকে কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো, কী অদ্ভুত; তার বাবা- মারও তাদের মত নামের মিল ছিল। 

বিয়ের দুই বছরের মাথায় মেয়ে মিলার জন্ম । ভালো নাম মোসাম্মত মহাব্বাতজান। বাবা-মা'র নামের সাথে প্রথম অক্ষর ছিল 'ম ', তাই তার মেয়ের নামও হলো সেটা মিলিয়ে। শামসুর মনে হত তার মেয়ে দেখতে তার মায়ের মতো । যদিও সে কখনো মাকে দেখেনি, কিন্তু তার মনে দেয়ালের সে-ই ছবি গেঁথে আছে, যার দিকে বাবা রাত জেগে তাকিয়ে থাকতেন। 

৫ 

শামসুর মনে একটা কথা সারা দিন-রাত বাজে, "বাবা পারলে আমার জন্যে হজ্ব করিস" শহরে আসার পর থেকেই সে টাকা জমাচ্ছে। কিন্তু অল্প টাকার চাকরী। এর মধ্যে মিলার জন্মের পরে শামসুন আর কাজে ফিরে যায় নি। সময় কত দ্রুতই না কেটে গেল। তার ঢাকায় আসার প্রায় চল্লিশ বছর হল। এখন তার কাছে যে টাকা আছে তা দিয়ে হজ্ব হয়ে যাবে। 

সে শুধু টাকাই জমায় নি; হজ্বের সব নিয়ম কানুন এখন তার মুখস্ত। কত বার স্বপ্নে দেখেছে, ইহরাম পড়ে বলছে, "বিসমিল্লাহে আল্লাহু আকবার ......." কাবা শরীফের চারিদিকে ঘুরে তোয়াফ করছে, সাফা আর মারওয়া পাহাড়ে মধ্যে ইসমাইলের মায়ের মতো ছট-ফট করে দৌড়াচ্ছে পানির খোঁজে আর শয়তানকে পাথর মেরে বলছে , তুই এরকম বেয়াদবি না করলে পৃথিবীতে এত অশান্তি হতো না। আবার স্বপ্নে অনেক বার জমজমের পানিও পান করেছে । এতে তার মন, শরীরের দুইয়ের মধ্যে এসেছে চরম প্রশান্তি।  

৬ 

সময়ের সাথে মিলা স্কুল, কলেজ দুই শেষ করলো । বিভিন্ন জায়গা থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসতে থাকলো । ভালো একটা ছেলে দেখে আদরের মিলাকে শামসু আর শামসুন বিয়ে দিয়ে দিলেন। শামসু ভাবলো এই বার সে নিশ্চিন্তে হজ্বে যেতে পারবে। 

বিয়ের দু-সপ্তাহের মাথায় মিলা কাঁদতে কাঁদতে বাসায় ফিরে আসলো। বললো ছেলের বাবা-মা কসাই, তাকে মার ধোর করেছে। বলেছে যৌতুক লাগবে। শামসু কথা বলতে গেল বেয়াই বাড়িতে। তাদের চেহারা এখন সম্পূর্ণ অন্য। তাদেরকে আড়াই লাখ টাকা দিতেই হবে। 

শামসু বিধ্বস্ত । আরো বেশী বিধ্বস্ত শামসুন। এর মধ্যে জটিলতা আরো বাড়লো l মিলা একদিন রক্তাক্ত হয়ে ফিরে এলো। বাবা তোমরা আমাকে কোথায় বিয়ে দিলে। 

এক মাত্র সঞ্চয় তার হজ্বে যাবার টাকা। তাও মাত্র দু লাখ ২০ হাজার টাকা । শামসু-শামসুন ঠিক করলো, এ টাকাটাই তারা দিয়ে দিবে। কিন্তু তার পরেও তো ত্রিশ হাজর টাকা কম। তাদের ভাবনা আর শেষ হয় না। এর জন্যে কলিজার টুকরো মেয়েটার উপর আবার অত্যাচার না নেমে আসে। শামসুনের মনের সাথে শরীরও ভাঙ্গতে থাকলো। শামসু একদিন সকালে শামসুনকে ঘুম থেকে ডেকে উঠাতে পারলো না। সেও ওই পারে যাত্রা করেছে। 

শামসুনের মৃত্যু শামসুর জন্যে মেনে নেয়া সম্ভব হচ্ছিল না। চাকরীতে থেকে মন উঠে গেলো। বাড়ির আসবাব পত্র বিক্রি করে আর হজ্বের জন্যে জমানো টাকা সে বেয়াই বাড়িতে দিয়ে আসলো। মেয়ে, জামাই আর সবাইকে সে বলে আসলো, পায়ে হেঁটেই হজ্বে যাবে। তাদের সাথে আর দেখা হবে না। সবাই ভাবল, শামসুর হয়তো মাথা খারাপ হয়ে গেছে। এখনকার দিনে কি আর কেউ পায়ে হেটে হজ্বে যেতে পারে? 

৭ 

শামসুর সংগ্রহে ছিল হজ্ব বিষয়ক অনেক বই পত্র । মনোযোগ দিয়ে সে অনেক কিছু পড়েছে । কাবা ঘরের এক সময়ে ৩৬০ টা মূর্তিতে ভরা ছিল । পুরুষ মহিলারা নগ্ন হয়ে কাবা ঘরের চারিদিকে ঘুরে বেড়াতো। তোওবা, তোওবা; এ কি অবমাননা । রাসুল্লাহ (দঃ) নবীজী এগুলো সব বন্ধ করলেন। ইব্রাহিম নবী পরম করুণাময় আল্লাহ ত আলার আদেশেই এ ঘর বানিয়েছিলেন। এখানেই সেই কালো পাথর। যাতে নবীজী চুমু দিয়েছিলেন। সেখানে শামসুও চুমু দিতে পারবে , ভাবতেই চোখ ভিজে আসে। এই জায়গায় গেলে তার হজ্ব হবে। হজ্বের করতে পারলে নির্ভয়ে বাবা আর সে নিজে আল্লাহর সামনে যেয়ে দাঁড়াতে পারবে। বাবা মাকে মুখ দেখাতে পারবে। 

তখন শামসু জেনেছিল, এক লোক টাকা জমিয়ে হজ্বে না যেয়ে এক অভাবী লোককে টাকাটা দান করে দেয়, তার জীবন বাঁচানোর জন্যে। তিনি হজ্বে না গেলেও, হজ্বের সওয়াব ঠিকই পেয়েছিলেন। শামসু ভাবে, তার ঘটনাও তো অনেকটা একই রকম । মেয়ের জীবন বাঁচাতে, জমানো টাকাগুলো যৌতুক দিতে হয়েছে। কিন্তু এতে তার মন সায় দেয় না। বাবার অনুরোধ কি এটাতে রক্ষা হবে? 

গুনাহ মাফ করানোর অনেক গুলো হাদিস সে পড়েছিল । অজুর প্রতি ফোঁটা পানি একটা করে গোনাহ কমায়। সকালে সুর্য উঠার পরে নফল নামাজ পড়লে আরো বেশী গুনাহ মাফ হয় ---এরকম আরো অনেক । 

মনে হচ্ছে কোনো এক ওয়াজে সে শুনেছিল, ১০০ মানুষের কবর খুঁড়তে পারলে হজ্বের সওয়াব পাওয়া যায়। কিন্তু অনেক হাদিস সে খুঁজেছে, কিন্তু এই কথা সে খুঁজে পায় না। কয়েক জন আলেম লোককে জিজ্ঞাসা করেছে, কেও সঠিক উত্তর দিতে পারে নি। 

সৈয়দ শামসুল ইসলাম ঠিক করলো সে কবর খোদক হবে। কিন্তু সে জীবনে বিভিন্ন ধরণের কাজ করলেও, কখনো কারো কবর খুঁড়ে নি। আজিমপুর গোরস্তানে যেয়ে বসে থাকা তার কাজ হয়ে দাঁড়াল। প্রথমে খোদকদের কাজ দেখতো। পরে তাদেরকে সাহায্য করা আরম্ভ করলো। খোদকরা বিনা পয়সায় লোক পেয়ে খুশীই হলো। শামসু জানলো কবরের গভীরতা হতে হবে লাশের অন্ততত পক্ষে অর্ধেক। মাটি খুঁড়তে হবে দৈর্ঘে ৪ হাত, প্রস্থে পৌনে দুই হাত। আরো অনেক নিয়ম কানুন। মাটি নরম হলে কাঠ, পাথর বা লোহার সিন্দুকের মধ্যে কবর দেয়া যেতে পারে। লাশকে মাটিতে রেখে ডান কাঁধে কেবলা মুখী করে শোয়ানো সুন্নত। মৃতের গোসল আর জানাজা শিখতে বেশী সময় লাগলো না। বই পড়েও জানা হলো আরও অনেক কিছু।

৮ 

কয়েক দিন ধরে কবর খোদক সৈয়দ শামসুল ইসলামকে দেখা যাচ্ছে না। এর মধ্যে কেউ মারা যায় নি। তাই তার খোঁজ পড়ে নি। কিন্তু গত রাতে চৌধুরী বাড়িতে ডাকাতরা জোড়া খুন করে গেছে। 

গ্রামের দু জন ছেলেকে পাঠানো হলো শামসুকে ডেকে আনতে। অনেক ডাকা ডাকির পরেও শামসু কোনো জবাব মিললো না। দরজা ধাক্কা দিয়ে খুলে ঢুকতেই দেখল, শামসুর নিথর শরীরটা খাটের পাশে পড়ে আছে। মনে হচ্ছে কয়েক দিন আগে মারা গেছে। হাতে এক খন্ড চক (যা দিয়ে দেয়ালে লেখা যায়)।

মৃত শামসুর শরীরের পাশে দেয়ালে কিসের যেন একটা হিসাব। চারটা উপর নীচ আর একটা আড়াআড়ি রেখা। ঠিক টালি গোনার মতো। এ রকম ১৯ টা ঘর। ২০ নম্বর ঘরে চারটা উপর নীচ রেখা, আড়াআড়িটা নাই। কিন্তু শামসুর হাতে চক। 

১১/১১/১০

কাজী হাসান

প্রবাসী লেখক: quazih@yahoo.com

www.lekhalekhi.net