বৃক্ষ তোমার নাম কি?

এমেরিকায় কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা ও মৃত্যুর সংখ্যা কমে আসছে। স্বাভাবিক জীবন বেশ দ্রুত গতিতেই ফিরছে। অনেকটা হাফ ছেড়ে বাঁচার দশা। দীর্ঘ মহামারীর তাণ্ডব থেকে বুঝি রক্ষা পাওয়ার গেল! এ রকম এক সময়ে খবর পেলাম আমাদের পরিচিত একজন আব্দুস সামাদ (বাবু ভাই) হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। হার্ট অ্যাটাক করেছিল। পরে আরও জানলাম চারটা ব্লক ধরা পড়েছে। ওপেন হার্ট সার্জারি হবে। বিষয়টা নিয়ে একেবারেই উদ্বিগ্ন হলাম না। এখনকার দিনে কাজটা হরদম হচ্ছে। সাফল্যের হার বেশ ভালো। কিন্তু না, সৃষ্টিকর্তার পরিকল্পনা ছিল অন্যরকম। সার্জারি সফল হয়েছিল। তার পরপরই বড় ধরণের জটিলতা আরম্ভ হলো। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে ২১ মে (২০২১) বাবু ভাই চলে গেলেন না ফেরার দেশে।

বাবু ভাই’র একমাত্র সন্তান আদিবা ঐশী। সার্জারিতে যাওয়ার কিছু আগে তোলা বাবা-মেয়ের একটা ছবি ফেসবুকে আপলোড করেছিল। হাসপাতালে বিছানায় শোয়া হাস্য-জ্বল বাবা ও তার পাশে প্রিয় কন্যা। দুজনে একটা ছবির এ্যালবাম দেখছে। নিশ্চয়ই দারুণ সুন্দর কোনো স্মৃতি তাদের উদ্বেলিত করছিল। ছবিটা এখন পৃথিবীর অন্যতম সেরা পিতা-পুত্রীর চিত্রগ্রহণ বলে বিবেচিত হওয়ার যোগ্যতা রাখে (ছবিটা লেখাটার সাথে যুক্ত করে দিয়েছি)। যাই হোক ফিরে আসি বিষয়বস্তুতে। এ রকম সুন্দর একটা দৃশ্য আমাকে বিমোহিত করে রেখেছিল। তার কয়েক ঘণ্টার পরই অপ্রত্যাশিত খবরটা এলো।

বাবু ভাইকে আমি চিনি বহু বছর ধরে। সরাসরি অন্তরঙ্গতা বলতে যা বুঝায় তা হয়তো তেমন ভাবে গড়ে উঠেনি। কিন্তু পরোক্ষ সম্পর্ক তো ছিল-ই। তার স্ত্রী দীনা সামাদ আমাদের খুব কাছের একজন। সে ঢাকার প্রকৌশল (বুয়েট) বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা শেষ করে বহুদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছে। বিদেশে বাংলা সংস্কৃতিকে ধরে রাখার ক্ষেত্রে একেবারে নিবেদিত প্রাণ। চমৎকার গান গাইতে পারে। ডালাসের প্রায় প্রতিটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তার সক্রিয় উপস্থিতি। আমার নিজেরও তার সাথে বেশ কিছু অনুষ্ঠান করার সুযোগ হয়েছে। সেই সুবাদেই বাবু ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ। আমার কাছে মনে হয়েছিল তিনি নিজে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশ না নিলেও তার সমর্থন ও সহযোগিতা ছিল বলেই দীনার পক্ষে নানা অনুষ্ঠানে অংশ নেয়া সম্ভব হতো। একমাত্র বিশাল হৃদয়ের মানুষ হলেই স্ত্রীর সখের কাজে এভাবে উৎসাহ দেওয়া সম্ভব।

এইবার বলি রাজকন্যার কথা। বাবু ভাই ও দীনার কন্যা আদিবা ঐশী। আগেই বলছি সেই তাদের একমাত্র সন্তান। যুক্তরাষ্ট্রের এক নামজাদা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ালেখা শেষ করে এখন চাকরি করছে। প্রবাসে বেড়ে উঠলেও একজন খাঁটি বাঙালি। শুধু বাংলায় কথা বলা না, বাংলা সংস্কৃতির প্রতিটা বিষয়কে একেবারে অন্তর দিয়ে ভালোবাসে। মায়ের মতো তারও অদ্ভুত সুন্দর গানের গলা। অবাক হতে হয় প্রবাসে শত কাজে ব্যস্ত থেকেও আদিবা কেমন করে এতো সুন্দর করে বাংলা গান করে! আমাদের সাথে বেশ কয়েকবার “টেক্সাস টক” লাইভ অনুষ্ঠানে মা-মেয়ে অংশ নিয়েছিল। মায়া-ভরা মেয়েটা শুধু গান না; তার চিন্তা, ভাবনা, সচেতনতায় আমাকে মুগ্ধ করেছিল। এইবার একটা ঘটনা শেয়ার করি। লাইভ অনুষ্ঠানে বাবু ভাইও ফোন করে অংশ নিয়েছিলেন। মেয়ের সাফল্যে একজন গর্বিত বাবার আবেগময় কণ্ঠ আমরা শুনেছিলাম। আদিবার সাথে যতবার দেখা হয়েছে সে শুধু মনোযোগ দিয়ে নিজের মতামত আমাকে জানায়নি; খুবই আগ্রহ নিয়ে আমার প্রতিটা কথাও শুনেছে। প্রতিবারই বিস্মিত হয়েছি এটা ভেবে, তরুণ বয়সের মেয়েটা এতো বিনয়ী ও গুণী হয়ে উঠলো কি করে! পরের মুহূর্তেই নিজেই উত্তরটা খুঁজে পেয়েছি। যার মা এতো বড় মাপের মানুষ, বাবা এতো সংবেদনশীল তাদের কন্যা আর পাঁচজনের থেকে সেরা হওয়াটাই তো স্বাভাবিক।

এখন মা মণি আদিবা ঐশীকে কয়টা কথা বলি। আম্মু সোনা, আমরা সবাই জানি প্রতিটা জীবিত মানুষকেই মৃত্যুর স্বাদ নিতেই হবে। কেউ আগে গেছে, কেউ পরে যাবে। মৃত্যুবরণ করলে আত্মা শরীর থেকে বের হয়ে যায়, কিন্তু পারস্পরিক সম্পর্কটা অবশ্যই থেকে যায়। তোমার বাবা আছেন, নিজের অবস্থান থেকে সবাইকে দেখছেন। তোমার প্রতিটা আনন্দে তিনি খুশি হচ্ছেন। তুমি কোনো ব্যাপারে কষ্ট পেলে তিনিও ভারাক্রান্ত হবেন। আমরা জানি, তাকে ছাড়া তোমাদের জীবন অনেক বেশি চ্যালেঞ্জের হচ্ছে; কিন্তু তোমরা ঠিকই সামlলে উঠতে পারবে। পরম করুণাময়য় আল্লাহ তা আলা বলেছেন, মানুষ নিতে পারবে না এমন ভার তিনি কাউকে দেন না।

আমি তোমাকে তোমার বাবার মৃত্যুর দিনে দেখেছি। তুমি শুধু নিজের মনকে শক্ত করে রাখোনি, মাকে সান্ত্বনা দেয়ার গুরু দায়িত্বটাও কাঁধে তুলে নিয়েছিলে। দোয়া করি তোমরা যাতে এই ভাবেই এগিয়ে যেতে পারো। মনে রেখো, আমরা তোমাদের পাশে সব সময়-ই আছি। আমি জানি তুমি ফটোগ্রাফিতে একজন এক্সপার্ট। ক্যামেরা দিয়ে অদ্ভুত সুন্দর সব ছবি তুলতে পারো। আমরা ছবিগুলো দেখে বিস্মিত হই। তোমার মনের স্মৃতিভাণ্ডারে বাবার সাথে যেই ছবিগুলো আছে, সেগুলো খুব যত্ন করে রেখো; সুযোগ পেলেই দেখো। তাতে আরও বেশী করে অনুভব করবে, বাবা তোমাকে কি-ভীষণ-ই না ভালোবাসতেন!! শেষে Ernest Hemingway থেকে ধার নিয়ে একটা কথা বলিঃ Every man's life ends the same way. It is only the details of how he lived and how he died that distinguish one man from another.