Son hijo Sohn बेटा 儿子 পুত্র

বছর বার-তেরো আগের কথা। গাড়ির তেলের (এমেরিকায় বলে গ্যাস) দাম প্রচুর বেড়ে গেল। মার্কিনীরা বড় বড় গাড়ি ছেড়ে ছোট তেল সাশ্রয়ী গাড়ির দিকে আগ্রহী হওয়া আরম্ভ করল। এদের চলা ফেরাও অনেক কমে গেল। এই দেশের বেশীর ভাগ স্থানেই এক জায়গা থেকে আরেক জায়গা যেতে গাড়ির দরকার। কিছু বড় ও পুরনো শহর বাদ দিলে পাবলিক ট্রান্সপোর্টেশন নাই বললেই চলে। গ্যাসের দামের কারণে জনজীবন বেশ স্থবির হয়ে পড়ল। রেডিও, টেলিভিশনের টক শো থেকে আরম্ভ করে বেশির ভাগ জায়গায় আলোচনা বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়াল গ্যাসের উচ্চ দাম এবং সেটা আর কতো বাড়বে কিংবা মূল্য আদৌ কমবে কি-না!

বাড়তি খরচের কারণে বিষয়টা শুধু বড়দেরই ভাবিয়ে তুলল না; ছোটরাও এই সমস্যার প্রভাবে পড়ল। বাবা-মা একান্ত বাধ্য না হলে তাদের দূরে কোথাও নিয়ে যেতে চায় না। জাতিটার ছুটি-ছাটাতে দূরে কোথাও গাড়ি চালিয়ে যাওয়ার যে ঐতিহ্য আছে, সেটাও অনেকটাই ব্যাহত হয়ে পড়ল। খনিজ তেলের সাথে উদ্ভিদজাত ইথানলের ব্যবহার বেড়ে গেল। সাথে চলতে লাগল বিকল্প শক্তি উদ্ভাবনের নানা গবেষণা ও প্রচেষ্টা। বড়দের পাশাপাশি সচেতন শিশুরাও এ সমস্যা মোকাবেলার উপায় নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করছিল। আমার আট বছরের ছেলে শায়ের (ওর মা ডাকে বুবাই বলে, আমি বলি শাটটু) এক অভিনব সমাধান নিয়ে হাজির হয়েছিল।

কি সমাধান নিয়ে এসেছিল সেটা একটু পরে বলছি। কিন্তু তখনই আমার গর্বে বুকটা ভরে উঠেছিল। ছেলেটা গতানুগতিক গণ্ডির বাইরে বৃহত্তর একটা সমস্যা সমাধানের পথ বের করার জন্যে ভাবছে। সে এমন কিছু বের করতে চাচ্ছে, যা তেলের বিকল্প হতে পারে। সে আমার সাথে গম্ভীর হয়ে আলোচনা করল মানুষ যার থেকে মানে খাদ্য থেকে যদি শক্তি পায়; তা হলে একই প্রক্রিয়ায় সেই শক্তি দিয়ে গাড়ির চাকা কেনো ঘুরানো যাবে না। আমি তাকে বুঝানোর চেষ্টা করলাম, মানুষের খাবার থেকে যেই পরিমাণ শক্তিটা আসে তা গাড়ির মতো ভারী যন্ত্র চালানোর জন্যে একেবারে অপ্রতুল। শুধুমাত্র খনিজ তেল পুড়ালে ব্যাপক পরিমাণ শক্তি তৈরি হয় যেটা দিয়ে গাড়ি, প্লেন কিংবা অন্যান্য ভারী যন্ত্র চালানো সম্ভব। বেচারা কিছুটা দমে গেল। আমি ওকে উৎসাহ দিয়ে বললাম, “অবশ্যই তেলের সাশ্রয়ী বিকল্প বের করা সম্ভব। কিন্তু তার জন্যে নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে। অনেক পড়ালেখা করতে হবে। প্রথমেই এখনকার প্রযুক্তিতে যে যে প্রক্রিয়ায় শক্তি (Energy) তৈরি হচ্ছে, তার সবগুলোর প্রকৃতি জানতে হবে। তারপরেই না নতুন কিছু বের করতে পারবে।”

এখনকার দিনে সাধারণত দেখা যায় ছেলে মেয়েরা সহজ বিষয়গুলোর দিকে বেশি ঝুঁকছে। অল্প পরিশ্রম ও কম মেধা ব্যবহার করে যদি কাজটা হয়েই যায়, তা হলে বাড়তি কষ্ট করতে উৎসাহীদের সংখ্যা দিনে দিনে কমছে। মার্কিন দেশে মোটামুটি হাই স্কুল আরম্ভ করার সময় থেকেই উচ্চ শিক্ষা কোন লাইনে করবে সেটা ঠিক করে ফেলতে হয়। ছেলেটাকে পরামর্শ দিয়ে বলেছিলাম, নিজেকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে প্রস্তুত করতে পারলে কাজের চাহিদা কমার সম্ভাবনা একেবারেই কম। সে চ্যালেঞ্জিং বিষয়ে নিয়ে পড়ালেখা করার সিদ্ধান্ত নিলো। তারপরে বেশ অনেকগুলো বছর হয়ে গেছে। শায়ের মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে এই দেশের এক শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাস, অস্টিন থেকে মহাকাশ ও বিমান প্রযুক্তির (Aerospace Engineering) উপরে গ্রাজুয়েশন করেছে।

প্রথমে বেশ চিন্তিত ছিলাম এই করোনা ভাইরাস দুর্যোগকালে ওর চাকরি পাওয়াটা কষ্টকর না হয়ে যায়। কিন্তু সে শুধু একটা না বেশ কয়েকটা ভালো চাকরির অফার পেলো। তার মধ্যে একটা ছিল আমরা যেই শহরে বসবাস করি সেখানকার এক কোম্পানিতে। আমরা বাবা-মা খুশি হয়েছিলাম যে সন্তান আমাদের কাছাকাছি থাকবে। এই প্রতিষ্ঠান এমেরিকার বিশ্বখ্যাত যুদ্ধ বিমানগুলো বানায়। শায়ের আমাদের জানাল, অফার ভালো হলেও সে ওখানে কাজ করতে চায় না। সে আমাকে ব্যাখ্যা করল, “আমি কাজ করেছি এমন প্লেন যদি মানুষ খুন করে তা হলে মোটেও ভালো লাগবে না।” আমি তার সিদ্ধান্তকে সম্মান জানালাম।

আমার পিতামহ রহিমপুর নামে এক গ্রাম ছেড়ে শহরে এসেছিলেন। আমার বাবা চাকরির সুবাদে মেলা জায়গা ঘুরে শেষে ঢাকা শহরে বসত গেড়েছিলেন। বর্তমানে আমরা ভাইয়েরা বেশীর ভাগই দেশের বাইরে থাকি। একবার বাবা-মা আমাদের দেখতে এমেরিকা এসেছিলেন। তখন ঘটনাক্রমে তাদের ছোট একটা কথোপকথন আমি শুনেছিলাম। আমার মা বাবাকে প্রশ্ন করেছিলেন, “আমাদের ছেলেরা সব দেশ ছেড়ে বিদেশে এলো। ওদের ছেলে-মেয়েরা কোথায় যাবে?” মা বেশ কিছু বছর আগে বিগত হয়েছেন। বেঁচে থাকলে হয়তো বলতে পারতাম, তার পৌত্র-পৌত্রীরা পৃথিবী সবচেয়ে উন্নত প্রযুক্তির প্রতিষ্ঠানে মানুষের জীবন সহজ ও সুন্দর করার জন্যে কাজ করবে। তারা নিজেরা সৎ ও নীতিবান মানুষ হবে। তারা মানুষকে ভালোবাসবে, মানুষের সেবায় নিজেদেরকে উৎসর্গ করবে।

(বি দ্রঃ পরম করুণাময়য়ের অশেষ কৃপায় ও সবার আশীর্বাদে শায়ের ক্যালিফোর্নিয়ায় একটা হাই টেক কোম্পানিতে আজ থেকে কাজ আরম্ভ করছে। আপনারা সবাই দোয়া করবেন সে জন্যে তার স্বপ্ন পূরণে সমর্থ হয়)

জুলাই ২০, ২০২০