চট্টলার ভালোবাসা

একটা বিষয়ে বাঙালি নিঃসন্দেহে বিশ্ব সেরা। সেটা হলো অতিথি আপ্যায়ন। কাজটাতে বাঙালির বিন্দু মাত্র কার্পণ্য নাই। তবে আপ্যায়নে বাঙালি বিশ্ব সেরা হলেও, আমার মতে বাংলাদেশের মধ্যে সেরা আসনের দাবীদার চট্টগ্রাম হতে পারে!  কথাটা শুনে অন্য জেলার মানুষেরা হয়তো কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত হবেন; তারাই বা কম কিসে। এইসব বন্ধুদের  কাছে বিষয়টা ব্যাখ্যা করার একটা  সুযোগ নিতে চাই।  

ফোনে বাল্যবন্ধু লিটনকে জানালাম, এবার দেশে যেয়ে শৈশবের বিদ্যালয় সেন্ট প্লাসিড’স হাই স্কুল দর্শন করতে চাই। আমি সেখানে দীর্ঘ দিন পড়ালেখা করেছি, ক্লাস এইটে বৃত্তি পেয়েছি, ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়েছি।  সেখানে আরও হাজার অম্ল-মধুর স্মৃতি মিশে আছে।  এ পর্যন্ত জীবনে আমি যতটুকু পথ চলতে পেরেছি, তাতে এই প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব অনস্বীকার্য।  আমার এই স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করল লিটন।  চল্লিশ বছর পর স্কুলের আঙ্গিনায় যেয়ে দাঁড়ালাম। ১৮৫৩ সালে প্রতিষ্ঠিত স্কুলের মূল অংশটুকু ঠিক আগের মতো তিন তলাই আছে। অবশ্য কিছু সংযোজনও হয়েছে।  দু বন্ধু মিলে নানা স্মৃতি রোমন্থন করলাম। আমাদের কোন বছর কোথায় ক্লাস রুম ছিল, কোন শিক্ষক কতো কড়া ছিলেন, কিংবা কি কি দুষ্টামি করা হতো ধরণের বহু গল্প করলাম। ঘটনাগুলো অনেকটা চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে ভেসে উঠল । সন্তুষ্টি ও কষ্টের এক মিশ্র অনুভূতি নিয়ে স্কুল ভ্রমণ শেষ করলাম।  

এক সময়ে ক্লাসের প্রত্যেক ছাত্রই বন্ধু ছিল। সময়ের বিবর্তনে বেশির ভাগকেই হারিয়ে ফেলেছি। তবে যাদের সাথে এখনও যোগাযোগ আছে তাদের একজন হলো ফাহমিদ। দেখলাম ফাহমিদ ও লিটন আমাদের ( স্ত্রী ও শ্যালিকা সাথে ছিল)  দেড় দিনের চট্টগ্রাম  সফর উপলক্ষ করে বিশাল আয়োজন করে রেখেছে। আয়েশি জায়গায় রাত্রি যাপন ছাড়াও ওরা আমাদের নিয়ে গেল চট্টগ্রামের অদূরে ভাটিয়ারী গলফ ক্লাব অঞ্চলে। আমার পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের উল্লেখযোগ্য স্থান ভ্রমণের সুযোগ হয়েছে;  কিন্তু বন্দর নগরীর ঠিক পাশেই উঁচু-নিচু ঢালু পাহাড়ি ভূপ্রকৃতির ও  সমুদ্রের কাছাকাছি সবুজের বনানীর সমারোহ নিয়ে এমন নয়নাভিরাম জায়গাটার সাথে পরিচয় ছিল না।  অঞ্চলটার  নিজস্ব একটা অনন্য সৌন্দর্য আছে।  পাহাড়গুলোর মাঝে প্রশস্ত একটা লেক কাঁটা হয়েছে। সেখানে আমরা নৌ ভ্রমণ করলাম। হৃদয়ের ঠিক মাঝখানটা মুগ্ধতায় শীতল হয়ে উঠল।  কবি নজরুল ইসলামের “এ কি অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরিনু পল্লী-জননী”  কথাটার মর্মার্থ আরও বেশি করে উপলব্ধি করলাম।  

আমাদের এই স্বল্প সময়ে চট্টগ্রামে উপস্থিতি যাতে আপ্যায়নে কোন কমতি না হয়, সে জন্য ফাহমিদ,  লিটনের সাথে যোগ দিয়েছিল ছোট বেলার পাড়ার বন্ধু জামিল। সাথে আর দুজনের নাম উল্লেখ না করলে বড় ধরণের একটা অপরাধ হয়ে যাবে। প্রথম জন হলো লিটনের প্রিয়তমা সোমা ভাবী। মানুষটা যে কি ভীষণ আন্তরিক, সেটা কাছের মানুষেরা সবাই জানে। আরেকজন হলো ফাহমিদের ‘বেটার হাফ’ শারমিন ভাবী। একই বয়সের হওয়াতে তাকে বান্ধবী করে নিতে সময় লাগল না। তারও কঠোর দৃষ্টি ছিল আমাদের স্বাচ্ছন্দ্য যাতে সবসময়ে কমপক্ষে ১১০% থাকে।  আমরা এই কয়জনে মিলে বিরতি-হীনভাবে পৃথিবীর সবগুলো বিষয় নিয়ে আড্ডা দিলাম। তার পরে এই স্বল্প সময়ে স্বয়ং নায়ক-নায়িকাদের মুখ থেকে তাদের প্রেম কাহিনী ও মিলন গাঁথা শোনা হলো!  হাসতে হাসতে ঘড়ির কাঁটা ঘুরতে ঘুরতে যে কখন ভোর হয়ে যাচ্ছিল সেটা বুঝতে বেগ পেতে হয়েছিল।  

 চট্টগ্রামের যতো ধরণের উল্লেখযোগ্য খাবার আছে, তার বেশীর ভাগের স্বাদ নিলাম।  এগুলো আমরা ঠিক ভাবে উপভোগ করছি কি-না, তার দিকে বন্ধুদের কড়া নজর ছিল। লিটন চাচ্ছিল চট্টগ্রামের বিখ্যাত ও আমার পছন্দের ‘কালো-ভুনা’ খাওয়াতে। কিন্তু সময়ের অভাবে এই আইটেম পরের বারের জন্যে তুলে রাখতে হলো। কথায় কথায় চট্টগ্রামের প্রসিদ্ধ  ‘ বেলা বিস্কুটের’ কথা এলো। লিটন গাড়ি ঘুরিয়ে আমাদেরকে ‘গণি বেকারি’ তে নিয়ে গেল। প্রচুর বিস্কুট কিনে দিয়ে আমার স্ত্রীকে শর্ত দিলো, “এমেরিকায় যতবার বিস্কুট খাবেন, ততবার আমার কথা মনে করবেন।”  এখানে বেলা বিস্কুট নিয়ে কয়েকটা তথ্য দেই।  বলা হয়ে থাকে উপ-মহাদেশের প্রথম বেকারি এই চট্টগ্রামেই হয়েছিল। যা পরবর্তীতে গণি বেকারি নামে পরিচিতি পায়। পর্তুগীজদের থেকে চট্টলার মানুষরা বেক করা শিখেছিল। গত ২০০ বছর ধরে আজও সেই পুরনো প্রক্রিয়ায় মাটির চুল্লিতে বেলা বিস্কুট বানানো হচ্ছে। বাংলাদেশের গণ্ডি পার হয়ে সারা বিশ্বে এখন বেলা বিস্কুট পরিচিতি পেয়েছে।  

ফেসবুকে ছবি দেখে বন্ধু সোহেল হাসনাত ফোন করল। দু দিন পর তার মেয়ের বিয়ে। বারবার অনুরোধ করল সেই অনুষ্ঠানে যাতে আমরা থাকি। আরেক বন্ধু শামীম গাফফার ফোন করল। চল্লিশ বছর পর ওর গলার আওয়াজ শুনলাম। ওর  জীবনের নানা বৃত্তান্ত শুনলাম। সে জানাল একবার হলেও সামনা সামনি দেখা করতে চায়। কিন্তু সময়ের অভাবে কোনোটাই হলো না। হঠাৎই একটা বিষয় মনে পড়ল। ছোট বেলায় কত সহজেই না সম বয়সীদের সাথে গভীর বন্ধুত্ব তৈরি হয়ে যেতো।  এক অপরকে আপন  করে ‘তুই’ বলে সম্বোধন করতাম। এতোগুলো বছর পার ও যোগাযোগ বিরতি থাকার পরও বন্ধুরা আমরা এখনও ‘তুইতোকারি’ করে কথা বলেছি। জীবনের চলার পথে কত মানুষের সাথেই না পরিচিত হয়েছি।  কিন্তু সেই  ‘তুইতোকারি’ সম্পর্ক আর হয় না। 

শেষে ছোট আরও একটা ঘটনা বলি।  সাথে এতোগুলো বেলা বিস্কুট দেখে চট্টগ্রাম বিমান বন্দরে সিকিউরিটি চেক করেন এমন এক মহিলা  উচ্ছ্বসিত হয়ে গর্বিত কণ্ঠে বললেন, “বেলা বিস্কুট খুবই মজার। নিশ্চয়ই আপনাদেরও খুব প্রিয়।”  উত্তরে আমি বিগলিত হয়ে বললাম, “একেবারে এমেরিকা নিয়ে যাচ্ছি। সেখানে আয়েস করো খাবো।” এইবার একটু ফাস্ট ফরওয়ার্ড করি। এর মধ্যে আমরা এমেরিকায় ফিরে এসেছি। আমার স্ত্রী  এক কাপ চায়ের সাথে পাঁচটা বেলা বিস্কুট খেয়ে ফেলল। সে ঢাকায় বেড়ে উঠা মানুষ;  বেলা বিস্কুটের স্বাদ হয়তো আগে পায়নি।  আমি আঁতকে উঠলাম,  “এইটা কি করলে? লিটন না বলেছে প্রতিটা বিস্কুট খাওয়ার সময় ওকে মনে করতে।”  অবশ্য ঘটনাটা লিটনকে বলা হয়নি। হৃদয়ে যার বসবাস, তাকে মনে করতে কোনো উপলক্ষ লাগে না। আসলে পুরো দেশটা আর দেশের মানুষের মধ্যে যে এতো ভালোবাসা আর মায়া, তা কি ক্ষণিকের জন্য ভুলে থাকে যায়? 

কী শোভা, কী ছায়া গো, কী স্নেহ, কী মায়া গো—

কী আঁচল বিছায়েছ বটের মূলে, নদীর কূলে কূলে।

জানুয়ারি ৯, ২০২২